Advertisement
২১ মে ২০২৪
মালিয়াড়া-কাণ্ড

গ্রেফতারি এড়িয়ে সেই বাপ্পাও হাইকোর্টে

বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! বড়জোড়ায় মালিয়াড়ার প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধরের ঘটনায় একের পর এক চুনোপুঁটি তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করে যাচ্ছে পুলিশ।

বাপ্পা চন্দ্রাধূর্য।—ফাইল চিত্র

বাপ্পা চন্দ্রাধূর্য।—ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০৭
Share: Save:

বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! বড়জোড়ায় মালিয়াড়ার প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধরের ঘটনায় একের পর এক চুনোপুঁটি তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করে যাচ্ছে পুলিশ। এলাকায় সকাল-বিকেল দফায় দফায় পুলিশের জিপ গিয়ে টহলও দিচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ওই ঘটনার মূল হোতা বলে অভিযুক্ত মালিয়াড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য বাপ্পা চন্দ্রাধূর্য কেবল পুলিশের নাগালের বাইরেই থেকে গেলেন তা নয়, কলকাতা হাইকোর্টে গিয়ে আগাম জামিনের আবেদনও করে ফেললেন! হাইকোর্ট বাঁকুড়া পুলিশের কাছে মামলার কেস ডায়েরি তলব করতে টনক নড়ল তাদের!

এই ঘটনাই বিরোধীদের ফের বাঁকুড়া জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিল। তাদের অভিযোগ, অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মীকে পলাতক দেখিয়ে তাকে আদতে গ্রেফতারি এড়ানোর সুযোগ করে দিল পুলিশ। তাই তো সটাই কলকাতায় গিয়ে হাইকোর্টে আগাম জামিনের করার সুযোগ পেয়ে গেল সে।

বস্তুত বিরোধীদের এই অভিযোগকে সহজে উড়িয়ে দিতে পারছেন না অনেকে। কারণ এই জেলাতেই ইতিপূর্বে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এমন কিছু ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন, অপরাধের দিক দিয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পুলিশ তাদের গ্রেফতারের সাহস দেখাতে পারেনি বলে অভিযোগ।

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে সোনামুখীতে বুথে ঢুকে ভোটকর্মীদের মারধর করে সঙ্গীদের নিয়ে দেদার ছাপ্পাভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিদায়ী বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে। অত গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ দীপালির নাগাল পায়নি। পুলিশ বারবার দাবি করে আসে, তিনি এলাকায় নেই। অথচ মাসখানেক পরে দীপালি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসে দাবি করেছিলেন, তিনি কোথাও পালাননি। দীপালিরই ঘনিষ্ঠ সোনামুখীর মহিলা তৃণমূলের শহর সভাপতি পুতুল গড়াইয়ের বিরুদ্ধে মাসখানেক আগে গার্হস্থ্য সমস্যায় নাক গলাতে গিয়ে এক অন্তঃসত্ত্বার পেটে লাথি মারার অভিযোগ ওঠে। দল তাঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু সেই পুতুলকেও পুলিশ এলাকায় দেখতে পায়নি। যদিও বিভিন্ন সূত্রে শোনা যায়, পুতুল এলাকাতেই রয়েছেন। পরে তিনি বাঁকুড়া আদালতে আগাম জামিনের আবেদন করে পরে বিষ্ণুপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

দীপালিরই ঘনিষ্ঠ (এ বারের নির্বাচনে দীপালির নির্বাচনী এজেন্ট) তৃণমূলের পাত্রসায়রের নেতা গোপে দত্তের বিরুদ্ধেও গত কয়েকবছর ধরে নানা অভিযোগ উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ কখনও হাইকোর্টের ধাঁতানিতে গ্রেফতার করলেও অধিকাংশ মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। কয়েকবছর আগে পাত্রসায়রের এক বধূ ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছিলেন। অভিযুক্তের হয়ে গোপে ওই বধূর পরিবার যাতে থানায় অভিযোগ জানাতে না যায়, সে জন্য চাপ দিয়েছিলেন এবং সালিশি সভাও করেছিলেন বলে অভিযোগ। পুলিশে অভিযোগ জানাতে না পেরে ওই বধূ আত্মঘাতী হন। গোপের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি। পরে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে আসেন গোপে। এই গোপের বিরুদ্ধে ফের দলের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে পাত্রসায়র থানায় দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে পুলিশকর্মীকে মারধর করা ও তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনায় পুলিশ মামলা করেছিল। কিন্তু গোপে তবুও অধরাই থেকে যান। ওই মামলায় বেশ কিছুদিন পরে গোপে বিষ্ণুপুর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়ে যান।

এ বার বিধানসভা নির্বাচনের আগের দিন রাতে মালিয়াড়ার পরীক্ষাপাড়া প্রাথমিক স্কুলের বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ চারজনকে মারধরের অভিযোগ ওঠে বাপ্পা ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে। পুলিশ ও বিডিও-র বিরুদ্ধে গোড়ায় অভিযোগ নিতে গড়িমসি করার অভিযোগ ওঠে। শেষে জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে মামলা হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ আগেই পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছিল। মঙ্গলবার আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃত শিবশঙ্কর ফৌজদারকে বুধবার বাঁকুড়া আদালতে তোলা হলে আগামী বুধবার পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।

কিন্তু মূল অভিযুক্ত বাপ্পাকে কেন পুলিশ ধরতে পারেনি? জেলা পুলিশের এক কর্তা দাবি করেন, ‘‘ঘটনার পর বাপ্পার মোবাইলের টাওয়ারের সর্বশেষ ‘লোকেশন’ পাওয়া গিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদা। তারপর সম্ভাব্য জায়গায় তল্লাশি করেও ওর হদিস মেলেনি। তবে গ্রেফতারি এড়াতে বাপ্পা যে হাইকোর্টের দারস্থ হবে তার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ তৃণমূলের সৌমিত্র খাঁ। শেষ পর্যন্ত হলও তাই। তৃণমূল সূত্রের খবর, সোমবার হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন বাপ্পা। পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার হাইকোর্ট থেকে ইমেল করে ওই ঘটনার কেস ডায়েরি তলব করা হয়েছে।

পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলছেন, “প্রতিটা ঘটনায় একের সঙ্গে আর একটির অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। দীপালি গ্রেফতার হলেন না, এ বার ধরা পড়ল না বাপ্পাও। পুলিশ দলদাসে পরিণত হলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।” যদিও পুলিশ তা মানতে নারাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

High Court Bappa Arrest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE