Advertisement
E-Paper

ফের বেজে উঠুক মিলের সাইরেন

ভূগোলের পাতা থেকে ইতিহাসের অধ্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে আমোদপুর। জেলা ছাড়িয়ে, ভিন্ জেলার জনান্তি একে উত্তরণ বলতে নারাজ। তাঁদের কাছে, এ আসলে অবনমন। আমোদপুর তাই মিলের সাইরেন শুনে ফিরতে চায় ফেলে আসা আমোদপুরেই! এক সময় চিনির কলের সুবাদে ভুগোলের বইয়ের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল আমোদপুর। শিক্ষক মশাইদের প্রশ্ন করতে শোনা যেত, বলতো, চিনির কল কোথায় আছে? পড়ুয়ারা গর্বের সঙ্গে সমস্বরে বলে উঠত, ‘আমোদপুর – আমোদপুর।’

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৫ ০০:০৩
খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে ‘আমোদপুর সুগার মিল’। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে ‘আমোদপুর সুগার মিল’। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

ভূগোলের পাতা থেকে ইতিহাসের অধ্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে আমোদপুর। জেলা ছাড়িয়ে, ভিন্ জেলার জনান্তি একে উত্তরণ বলতে নারাজ। তাঁদের কাছে, এ আসলে অবনমন। আমোদপুর তাই মিলের সাইরেন শুনে ফিরতে চায় ফেলে আসা আমোদপুরেই!

এক সময় চিনির কলের সুবাদে ভুগোলের বইয়ের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল আমোদপুর। শিক্ষক মশাইদের প্রশ্ন করতে শোনা যেত, বলতো, চিনির কল কোথায় আছে? পড়ুয়ারা গর্বের সঙ্গে সমস্বরে বলে উঠত, ‘আমোদপুর – আমোদপুর।’ সে গর্ব আজ ইতিহাস। জেলার কবি, অতনু বর্মনের আঞ্চলিক কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে সেই সুগার মিল। অতনু লিখেছেন,

‘‘গুড় গোলা কে সাপুটে খেলে হয় না চিনি আর,/ সাইরেনে আর ভুঁ বাজে না ঝুঁজকো অন্ধকার/ যারা সেখানে কাজ করত ক্যা জানে কি খায়,/ অদের ক্যানে পড়লো প্যাটে লাথি কুনো জবাব নাই’।’’

সাইরেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে কবে!

খোলে না তালা। ফসিল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল চত্বরে সুগার মিল। সার সার কর্মী আবাসন। আখ কেনার অফিস ঘরের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া চাষিদের আখ বিক্রির রসিদ। ছড়িয়ে রয়েছে আখ চাষের চুক্তিপত্র। মূল অফিস ঘরের সামনে নোটিশ বোর্ডে আজও লেখা রয়েছে ‘টাইম অফিস’। ভিতরে কোন ঘরের মাথায় ‘ ডিসপেনসারি’, কোনও ঘরের মাথায় ‘সিকিউরিটি’ অফিসের নাম ফলক লটকানো। মিলটাই যা বন্ধ!

মিলের ভিতরে আজও পুরুষানুক্রমে জটাধারী মন্দিরে নিত্য পুজো করে চলেছেন প্রদীপ চক্রবর্তীরা। মিল চালু থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁদের বেতন দিতেন। এখন মিলের সিকিউরিটির দায়িত্বে বেসরকারি এজেন্সির কর্মীরাই চাঁদা করে যৎসামান্য বেতন দেন।

প্রদীপবাবুর আশা, ‘‘ফের মিল খুলবে। কোনও নতুন উদ্যোগ শুরু হবে।’’ একই প্রত্যাশা ওই এজেন্সি’র কর্মী তথা সুগার মিলের প্রাক্তন বিদ্যুৎ কর্মী রোহিত কুমার মণ্ডলেরও। ‘‘এককালীন কিছু টাকা এবং নুন্যতম পেনশনে আমারা মিল বন্ধ হওয়ার পর আগাম অবসর নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন সুগার মিলের জায়গায় অন্য শিল্প হলে বর্তমান প্রজন্ম কাজের সুযোগ পাবে।’’

একসময় কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জমিতে কিস্তিতে কিংবা নিজেরা চাষ করত। আবার স্থানীয় চাষিদের দাদন দিয়েও আখ চাষ করানো হত। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, চাষিরা নিজেদের জমিতে বিকল্প চাষ শুরু করেছেন। অনাবাদী হয়ে পড়ে রয়েছে মিলের প্রায় নিজস্ব জমি। কিছু জমি বেদখলও হয়ে পড়েছে। একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে ১৯৫৫ সালে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘ন্যাশানাল সুগার মিল’ নামে ওই চিনির কলটি স্থাপিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র পাওয়ার পর আখ চাষের জমি-সহ ৬৭ একর জায়গায় প্রায় ৬ কোটি টাকার মেসিন পত্র নিয়ে গড়ে ওঠা মিলটিতে উৎপাদন শুরু হয় ২০৬০-৬১ সালে। এক সময় কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৮১ জন। নানান জটিলতা এবং লোকসানের ধাক্কায় ১৯৬৪ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে প্রাক্তন বিধায়ক সুনীতি চট্টোরাজের উদ্যোগে মিলটি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন রাজ্য সরকার। মিলের পরিবর্তিত নামকরণ হয় আমোদপুর সুগার মিল।

পশ্চিমবঙ্গ চিনি উন্নয়ন নিগম গঠন করে মিল পরিচালনার দায়িত্বভার সংস্থার হাতে তুলে দেয় সরকার। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে ফের উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু নানান টানাপোড়েনে ২০০২-০৩ সালে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৫ সালে আগাম অবসর দেওয়া হয় কর্মীদের। পাঁচ বছর পরে, নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয় আমোদপুর সুগার মিলের সমস্ত মেসিনপত্র।

তবু প্রতিক্ষাতেই দিন কাটে আমোদপুরের। জেলার রাজনীতির কারবারিদের সদিচ্ছায় আবার খুলবে সুগার মিল, এমন স্বপ্ন দেখেন তাঁরা। অতনু বর্মনের কবিতাতেও সেই আভাস, ‘‘বন্ধ গেটের তালা গুলান খুলতে যদি পারো,/ বুঝবো তবেই বাপের বেটা আহা সিদিন কবে,/ আখ পিষিয়ে গুড় নিঙুড়ে আবার চিনি হবে/ আবার চায়ে সদ প যাবো,/ আহারে তার লেগে, ভাঙা বুকের পাঁজর লিয়ে আখুনো আছি জেগে।’’

সুগার মিলের স্থানীয় ডাইরেক্টর ছিলেন বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলায় দণ্ডিত স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত রজতভূষণ দত্ত। তার ছেলে মিহির কুমার দত্ত বলেন, ‘‘কোনও সম্মান কিম্বা খ্যাতির প্রত্যাশা বাবা করতেন না। কিন্তু এক নতুন দেশের স্বপ্ন দেখেতেন। সরকার সুগার মিল সহ- আমোদপুরের অবলুপ্তপ্রায় প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিলে সেই স্বপ্নকে মর্যাদা দেওয়া হবে।’’

ফসিল হয়ে পড়ে রয়েছে এলাকায় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে তৈরি হওয়া একটি মার্কেটিং কমপ্লেক্স এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপও। যানজট সমস্যা এবং ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত ওই মার্কেটিং কমপ্লেক্সের ভগ্নপ্রায় সব্জিবাজার শেড বর্তমানে খাটালে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু মিল খুলবে কবে?

যেসব শিল্পের পুনজীবনের সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে। জমি সংক্রান্ত জটিলতার জন্য সরকারি পরিদর্শন স্বত্ত্বেও সুগারমিল নিয়ে কিছু করা যায়নি। আসলে পূর্বত্বন সরকার ওই জমি লিজ দিয়ে চলে গিয়েছেন। জট কাটলে বিকল্প শিল্পের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিডিও অতনু ঝুড়ি বলেন, ‘‘এলাকার বাসিন্দারা লিখিত আকারে তাঁদের দাবি জানালে, গুরুত্ব বুঝে ব্লক প্রশাসন তার ব্যবস্থা নেবে।’’

arghya ghosh ahamedpur sugar mill ahamedpur sugar mill siren ahamedpur closed sugar mill
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy