রাঁচি রোডে ক্লে সাহেবের এই বাংলো এখন পূর্ত দফতরের অফিস। ছবি: সুজিত মাহাতো
পিচ ঢালা চওড়া রাস্তা দিয়ে ছুটছে গাড়ি। চারপাশে উঁচু-উঁচু বাড়ি। ঝাঁ চকচকে দোকান-বাজার। রাতে রাস্তায় জ্বলছে পথবাতি। এ সব পুরুলিয়া শহরের এখনকার ছবি। কিন্তু ১৮৩৮ সালে কেমন ছিল পুরুলিয়া?
সময়ের চাকা গড়িয়ে দিলে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের এই এলাকা (জঙ্গলমহল) শাসনের জন্য মানভূম জেলা গঠন করেছিল। সেটা ১৮৩৩ সাল। এই মানভূম ছিল সুবাবাংলা বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রদেশের অন্তগর্ত। জেলা সদর হিসেবে প্রথমে বেছে নেওয়া হয়েছিল মানবাজার। পাঁচ বছর পরে ১৮৩৮ সালে জেলা সদর সরিয়ে নিয়ে আসা হয় পুরুলিয়ায়। আজকের পুরুলিয়া শহর গড়ে ওঠার ইতিহাসের শুরু সেই তখনই থেকেই।
পুরুলিয়া নামের গ্রামটি ছিল ছড়রা পরগনার অধীনে। উত্তর ও পূবে যমুনা জোড় এবং দক্ষিণে কংসাবতী নদী। লাগোয়া দুলমি, ন’ডিহা, কেতিকা, আমডিহা, বেলগুমা, পালঞ্জা, মাগুড়িয়া, রাঘবপুর, ভাটবাঁধ প্রভৃতি এলাকা পরে পুরুলিয়া মৌজায় মিশে যায়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পুরুলিয়ায় গড়ে তোলা হয় থানা। সে সময় পুরুলিয়া থানার অধীনে ছিল হুড়া, পুঞ্চা, বলরামপুর, আড়শা পুলিশ চৌকিগুলি। লাগদা, ছড়রা, লধুড়কা, পলমা, কাঁসাইপার, বাগদা ও রাকাব পরগনাও ছিল এই থানার আওতায়।
সরকারি কাজকর্মের জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবন গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়ে যায়। এই জেলার অন্যতম বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার আর্থার লয়েড ক্লে একটি বাংলো গড়েছিলেন। প্রবীণদের কাছে শোনা যায়, এই বাড়িতে তাঁকে একবার বাঘে কামড়েছিল। সেই কামড়ের ক্ষত তাঁর আর সারেনি। পরে ক্লে সাহেবের বোন সরকারকে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। ১৮৮০ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের ৩১ অক্টোবর, পুরুলিয়া জেলার বঙ্গভুক্তির আগে পর্যন্ত এই বাড়িটিই ছিল মানভূমের ডেপুটি কমিশনারের বাংলো। রাঁচি রোডের সেই বাংলোটি এখন পূর্ত দফতরের অফিস। পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের ষোড়শ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরে পুরুলিয়ার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এসে জে সি সেনগুপ্ত যে বাংলোটিতে উঠেছিলেন সেটি এখন জেলা পরিষদের সভাধিপতির আবাস। রাঁচি রোডে জেলাশাসকের বাংলো অবশ্য অত পুরনো নয়। ১৯৬৪ সালে বাংলোটি তৈরি হয়।
১৮৭১ সালের পরেই আদালত, ডাকঘর, জেলা পুলিশ অফিস, জেলখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠে। জেলখানা মোড় লাগোয়া মানভূম ক্রীড়া সংস্থার মাঠ একসময় জেল গ্রাউন্ড নামে পরিচিত ছিল। বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সরকারি ভবনটিই জেলা শহরের প্রাচীন প্রশাসনিক কার্যালয় বলে জানা যায়। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এই ভবনেই নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ চলত। এই ভবনটি আগে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট ছিল। এই এলাকার দীর্ঘকালের বাসিন্দা ভগবতী প্রসাদ সিংহ দেওয়ের কথায়, “স্বাধীনতার আগে অবধি এই রাঁচি রোডের বেশিরভাগ এলাকা ছিল ফাঁকা। জেলা জজের বাংলো ও পুলিশ সুপারের বাংলোর আশপাশেও কোনও বাড়িঘর ছিল না।” শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের কথায়, শোনা যায় বর্তমানে যে এলাকার নাম মুন্সেফডাঙা, সেখানেই এক সময় ছিল মুন্সেফ কোর্ট। প্রিয়নাথ শর্মা ছিলেন প্রথম মুন্সেফ। তাঁর বাড়ি ছিল ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে।
সদর পাড়ায় রাজার বেড় বলে যে এলাকাটির পরিচয়, তা ছিল পঞ্চকোট রাজার সেরেস্তা। এটিই ছিল জেলা শহরে পঞ্চকোট রাজার মূল অফিস। কর্মচারীদের বসবাসের জন্য একাধিক আবাসনও ছিল এখানে। আর পঞ্চকোট রাজের মূল বসতবাটি ছিল রাঁচি রোডে। সেই বাড়ির নাম ছিল ‘ধীরাজগঞ্জ’। গবেষক দিলীপবাবুর কথায়, “বিরাট বাগান ঘেরা বাড়ি ছিল। শোনা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিছুদিন এই বাড়িতে বসবাস করেছেন। ১৯৫৬ সালে পঞ্চকোটের মহারাজা শঙ্করীপ্রসাদ সিংহ দেও ধীরাজগঞ্জের কিছুটা অংশ পুরুলিয়া ক্লাবকে ও বাকি অংশ রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়কে দান করেন। রাঁচি রোডের তখন নাম ছিল মহারাজ কল্যাণীপ্রসাদ রোড। তখন রাস্তাটি ডাকঘর থেকে জেলা জজের বাংলো পর্যন্ত ছিল।
তখন পুরুলিয়ার মধ্যে বড় কোনও জলাশয় ছিল না। পানীয় জলের উৎসের জন্য ১৮৪১ সাল থেকে দু’বছর ধরে খনন করে ৮৫ একর জায়গায় ‘সাহেববাঁধ’ তৈরি করা হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন মানভূমের তৎকালীন ডিসি কর্নেল টিকেল সাহেব। শহরবাসীর চিকিৎসার জন্য ১৮৮৮ সালে গড়ে ওঠে লেডি ডাফরিন হাসপাতাল। এখন চাইবাসা রোডে যেখানে পূর্ত দফতরের অফিস রয়েছে, সেখানেই ছিল এই হাসপাতাল। পরে ১৯২৫ সালে হাসপাতাল স্থানান্তরিত হয়। নন্দলাল ঘোষের তিন সন্তানের দান করা ২০ বিঘা জমির উপরে পঞ্চোকোটের রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও-র এক লক্ষ টাকায় হাসপাতাল তৈরি হয়। নাম হয় জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও ইন্ডোর হাসপাতাল। আর বহির্বিভাগের নাম ছিল নন্দলাল চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারি। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে কংগ্রেস নেতা দেবেন মাহাতোর মৃত্যুর পরে তৎকালীন রাজ্য সরকার হাসপাতালের নাম বদলে দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতাল করেন।
জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মিয়স্থানও তৈরি হয়। দিলীপবাবু জানান, নডিহা, বেলগুমা, দুমদুমি-সহ পাঁচটি মৌজার জমিদার ছিলেন বেনজির বেগম নামে এক মহিলা। ১৮৭৬ সালে বেনজির কয়েকজন পাঠান পুলিশকে খোলা জায়গায় নমাজ পাঠ করতে দেখে ওই জায়গায় মসজিদ তৈরি করে দেন। সেটাই এখন জামা মসজিদ। ১৮৬২ সালে গড়ে ওঠে জিইএল চার্চ ও ১৮৯১ সালে ইংলিশ চার্চ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই জিইএল চার্চে এসে একদা খ্রীস্টদাস নামে একজনের ধর্মপিতা হিসেবে কাজ করেছিলেন। পুরুলিয়ার পিতলের রথ ও রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সঙ্গীত শিল্পী মণি বাঈজীর নাম। ১৯০১ সালে তৈরি হয় পুরুলিয়া শহরের বিখ্যাত কালী মন্দির।
‘পশ্চিমে ছুটি কাটাতে’ কলকাতা থেকে অনেক অভিজাত ও মানীগুণিরা পুরুলিয়ায় আসতেন। তাঁরা বাড়িও তৈরি করেছিলেন। যেমন আজ লোকে যা নিস্তারিণী কলেজ নামে চেনেন, একসময় তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ি ছিল। নিস্তারিণীদেবী দেশবন্ধুর মা। চিত্তরঞ্জনের স্মরণে রাস্তার নামকরণ হয় দেশবন্ধু রোড। এই বাড়িতেই এসেছেন সুভাষচন্দ্র বসু, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী থেকে রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো ব্যক্তিত্ব। রাঁচি রোডে একটি বাড়ি ছিল চিত্তরঞ্জন দাসের ভাই পি আর দাসের। শোনা যায়, বিদ্যাসাগরের ভাগ্নের মেয়ের বাড়িও ছিল ওই এলাকায়। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া যে ইউনিয়ন ক্লাব রয়েছে, সেখানেই ছিল মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির বাংলো। দেশবন্ধু রোডের উপর টাওয়ার ভিলা, লেক ভিলা, তালুকদার কুটির বাড়িগুলি ছিল কলকাতার জোড়াবাগানের ঘোষেদের। এই রাস্তাতেই ছিল রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জামাতা নুটু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি।
১৮৭৬ সালে গঠিত হয় পুরুলিয়া পুরসভা। তা নিয়েও রয়েছে শহর গড়ে ওঠার অনেক কাহিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy