Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

চাকলতোড়ে ছাতা তুলে এক দিনের রাজা

রাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু, এক দিনের রাজা হয়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পরম্পরা মেনে ছাতা তুললেন চাকলতোড় রাজ পরিবারের রাজকুমার অমিতকুমার লাল সিংহ দেও। পুরুলিয়া তথা মানভূমের এই জনপ্রিয় লোক উৎসব ‘ছাতা পরব’-কে ঘিরেই এখনও টিঁকে রয়েছে এক দিনের রাজতন্ত্র।

পেশায় আলোকচিত্রী। বুধবারের রাজা।—নিজস্ব চিত্র

পেশায় আলোকচিত্রী। বুধবারের রাজা।—নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:২৬
Share: Save:

রাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু, এক দিনের রাজা হয়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পরম্পরা মেনে ছাতা তুললেন চাকলতোড় রাজ পরিবারের রাজকুমার অমিতকুমার লাল সিংহ দেও। পুরুলিয়া তথা মানভূমের এই জনপ্রিয় লোক উৎসব ‘ছাতা পরব’-কে ঘিরেই এখনও টিঁকে রয়েছে এক দিনের রাজতন্ত্র।

ভাদ্র সংক্রান্তির এই দিনটিতে শুধু পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে ছাতা পরবে সামিল হওয়া মানুষজনেরাই নন, লাগোয়া ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশা থেকে আসা লোকজনও এই দিনটিতে এই রাজকুমারকে রাজা বলেই মান্য করেন। এই উৎসবের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। কিন্তু, উৎসবের সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পঞ্চকোট রাজবংশের নাম। ওই রাজবংশের অন্যতম উত্তরপুরুষ সোমেশ্বর লাল সিংহ দেও জানালেন, একদা পঞ্চকোট রাজবংশের এক রাজা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু, বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরেও রাজার কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। রাজা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, না পরাজিত, সে সম্পর্কে প্রজা বা পরিবারের সদস্যেরা ছিলেন অন্ধকারে। তখন দূত মারফত খবর আসত। যেখানে দূতের দেখা মিলছিল, সেখানে খোঁজ নিয়েও রাজার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সোমেশ্বরবাবুর কথায়, “এই অবস্থায় রাজবাড়ির সকলের সঙ্গে প্রজারাও পড়লেন চিন্তায়। তাহলে কি কোনও দুঃসংবাদ মিলতে চলেছে? দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে যখন রাতে ঘুম নেই সকলের, সে সময় হঠাৎই একদিন খবর এল, রাজা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসছেন।” জনশ্রুতি, এর পরেই ঠিক হল রাজা যে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন, সেই খবর প্রজাদের জানাতে হবে। কিন্তু কী ভাবে প্রজাদের কাছে দ্রুত বিজয় সংবাদ পৌঁছে দেওয়া যাবে? তখন জয়ের প্রতীক হিসাবে ছাতা তুলে বিজয় বার্তা ঘোষণা করে দেওয়া হল।

ভাদ্র সংক্রান্তির এই দিনটিতে সেই বিজয় বার্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই থেকে আজও মানভূমে এই বিজয় দিবস ‘ছাতা পরব’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সেমেশ্বরবাবু বলেন, “পঞ্চকোটের রাজারা খুবই প্রজাবৎসল ছিলেন। তাই যখন রাজার বিজয় উৎসবের খবর রাজ্যে পৌঁছল, তখন সকলে মিলে আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। আর এই ছাতা সাদা রঙের। আমাদের কুলদেবতা শ্যামরঘুবর। তাঁর ছাতার রংও সাদা। সেই ছাতা তুলেই বিজয়ের খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।” তিনি জানান, পরবর্তী কালে পঞ্চকোট থেকে এই উৎসব চাকলতোড়ের রাজাদের কাছে চলে যায়। তখন বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজনকে নিয়ে আনন্দ করার মতো কোনও উৎসব এখানে ছিল না। তবে আজও কাশীপুরে ছাতামাড়া নামে একটি জনপদ রয়েছে। ইতিহাস বলছে, পঞ্চকোটের রাজধানী যখন কাশীপুরে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছিল, তখন এখানেই ভাদ্র সংক্রান্তিতে ছাতা তোলা হত।

রাজবংশের কোনও সদস্যের হাত দিয়ে ছাতা উত্তোলন করার প্রথা আজও প্রজাদের বা বিস্তীর্ণ এই এলাকার মানুষজনের কাছে আকর্ষণীয়। তাঁরা এই দিনটিতে চাকলতোড়ের মাঠে ভিড় জমান। এই একটা দিনের জন্য চাকলতোড় রাজবাড়ির রাজকুমার অমিতকুমার লাল সিংহ দেও প্রজাদের কাছে রাজা। পেশায় আলোকচিত্রী এই রাজার কাছে এ দিন ক্যামেরার বদলে কোমরে থাকে তরবারি। পরনে রাজবেশ। একদা ঘোড়ার পিঠে রাজবাড়ি থেকে রাজা যেতেন ছাতা উৎসবের মাঠে ছাতা তুলতে। এখন ঘোড়ার বদলে থাকে গাড়ি। তবে, আজও উৎসবের রীতি মেনে রাজবাড়ি থেকে মাঠ অবধি পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে মানুষজন রাজাকে উদ্দেশ করে ফুল ও দুর্বাঘাস ছোড়েন তাঁর মঙ্গল কামনায়।

পুরুলিয়ার সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো বলেন, “ছাতা উৎসবে শুধু এই জেলারই নয়, ভিন্ জেলা ও ভিন্ রাজ্য থেকেও এক দিনের রাজাকে দেখতে মানুষ আসেন। প্রথা মেনেই উৎসব চলে আসছে।” এ দিন কাশীপুরের ধবাড়ি থেকে ছাতা তোলা দেখতে এসেছিলেন রাজেশ টুডু, কেন্দা থেকে সুদীপ সিং সর্দার। তাঁদের কথায়, “একদা পঞ্চকোট রাজাদের রাজত্ব ছিল। সে রাজত্বকাল না থাকলেও প্রথা এখনও টিঁকে রয়েছে। একদিনের রাজাকে দেখতে এসেছি।” আর এক দিনের রাজা অমিতকুমার বললেন, “এই ছাতা তোলা আমাদের বংশের প্রথা। সেই ২০০০ সাল থেকে আমার উপরে বর্তেছে এই দায়িত্ব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

purulia chakoltor chata parab one day king
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE