শীত মানেই পায়ে পায়ে বেড়িয়ে পড়া। মরসুমের শুরুতেই তাই সাধ ও সাধ্যের মধ্যে কাছে পিঠে তেমন ঠিকানার খোঁজ পড়ে। বাড়ির পাশে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলেই রয়েছে অপার সৌন্দর্যের সেই সন্ধান। গহন শাল-মহুয়ার বনেই রয়েছে পর্যটক নিবাস।
কিন্তু একসময় মাওবাদী প্রভাবিত রানিবাঁধ ব্লকের ছেন্দাপাথরের সেই পর্যটক আবাস এখন তালা বন্ধ। মাওবাদী ভীতি কাটিয়ে জঙ্গলমহল স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও কেন খোলা হয়নি পর্যটক আবাস, সে প্রশ্নের উত্তর নেই অনেকের কাছেই।
রানিবাঁধের বিডিও সুমন্ত দেবনাথের অবশ্য আশ্বাস, “অনেক দিন আগে থেকেই ওই পর্যটক আবাসটি বন্ধ হয়ে রয়েছে, সেটিকে একটি গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকেরা আসা যাওয়া শুরু করলেই ছেঁদাপাথরের ওই পর্যটক আবাস ফের খুলে দেওয়া হবে।”
দূরদূরান্তের মানুষ আসবেন, জঙ্গলের ভিতর ঘুরবেন, রাত্রিবাস করবেন, এমন ভেবেই তৈরি করা হয়েছিল ছেন্দাপাথরের ওই পর্যটক আবাস। কিন্তু যাঁদের জন্য তৈরি হয়েছিল এই পর্যটক আবাস, তাঁদেরই দেখা মেলেনি। ফলে তৈরি হওয়ার এক বছরের মধ্যেই বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই পর্যটক আবাস বন্ধ করে দিয়েছিল প্রশাসন। তারপর ১৩ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। চেনা ছন্দে ফিরেছে জঙ্গলমহল। কিন্তু একসময়ের মাওবাদী প্রভাবিত রানিবাঁধ ব্লকের ওই পর্যটক আবাসের তালা আজও খোলেনি।
রানিবাঁধ থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে বারিকুল-ঝিলিমিলি রাস্তার পাশে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছেন্দাপাথর। ইতিহাসের পাতায় স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রামের নাম। কেন না, স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসু ১৯০৮ সালের ১১ অগস্ট এই গ্রামেই কিছুদিন আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে ২০০২ সালে রানিবাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির তরফে জঙ্গল ঘেরা ছেঁদাপাথরে তৈরি করা হয় ‘শহিদ ক্ষুদিরাম উদ্যান’।
সেখানেই দ্বিতল বিশিষ্ট পর্যটক আবাসটি নির্মাণ করা হয়। উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী উপেন কিস্কু। উপরতলায় রয়েছে একটি বড় ঘর, তিন শয্যা বিশিষ্ট ওই ঘরের প্রতিদিনের ভাড়া ধার্য করা হয় জন প্রতি মাত্র কুড়ি টাকা। নিচের তলায় রয়েছে একটি বিশ্রামাগার।
শহিদ ক্ষুদিরাম উদ্যানের মধ্যেই রয়েছে সাধু রামচাঁদ মুর্মু আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। তার থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এই পর্যটক আবাস। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উদ্বোধনের পর কিছুদিন পর্যটক আবাসটি খোলা ছিল। তখন মনে হয়েছিল, পর্যটকেরা আসা-যাওয়া করবেন। এতে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। অতিথি আবাসে তালা পড়ে যায়। সেই অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এলাকার মানুষজন থেকে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা অবশ্য এর জন্য মাওবাদী ভীতিকেই দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, ২০০৩ সাল থেকেই বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই এলাকার রাজনৈতিক পরিবেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
বারিকুল থানার এই এলাকায় একের পর এক সিপিএম নেতা কর্মী খুন হয়েছেন। অনেকেই ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ দেখে ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি পর্যটকরা আর জঙ্গলমুখো হয়নি। শহিদ ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত ছেঁদাপাথরেও তাই পর্যটকদের পা পড়েনি বললেই চলে। তার জেরেই উদ্বোধনের এক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক আবাসটি।
চালু হওয়ার পর এই পর্যটক আবাসের দেখাশোনা করতেন ছেন্দাপাথর গ্রামের বাসিন্দা ত্রিপুরা মাহাতো। প্রায় বিনা বেতনে বেশ কিছুদিন তিনি আবাসের কেয়ারটেকারের কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “চালু হওয়ার পর থেকে আবাসের সব কিছু দেখাশোনা করতাম। প্রথম থেকেই পর্যটকরা আসছিলেন না। কলকাতা ছেন্দাপাথর রুটের একটি সরকারি বাসের কর্মীরা রাতে এই পর্যটক আবাসে থাকতেন। পরে ওই বাসও আর চলেনি, কোনও টাকা পয়সা না পেয়ে আমিও পর্যটক আবাসের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। তারপর থেকে বন্ধই রয়েছে এই আবাস।” তাঁর আক্ষেপ, ভেবেছিলাম এই পর্যটক আবাসের দেখাশোনা করে কিছু টাকা পাব, কিন্তু কিছুই মেলেনি। সামান্য কিছু টাকা পেলেও আমি দেখাশোনা করতাম।
পরিবেশ বদলালেও কেন খোলেনি পর্যটক নিবাস? মহকুমা প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান, মাওবাদীদের ভয়েই এক সময় জঙ্গলমহলে পর্যটকেরা আসতে ভয় পেতেন। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ছেন্দাপাথরের ওই পর্যটক আবাসে রাত্রিবাসের জন্য পর্যটকেরা আসতে ইচ্ছুক নয়। নিরাপত্তা বাড়ালে তবেই পর্যটকেরা ঘুরতে আসবেন। নতুন করে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে রানিবাঁধের বিডিও সুমন্ত দেবনাথ বলেন, “শহিদ ক্ষুদিরাম উদ্যানটিকে নতুন করে সাজানোর চিন্তা ভাবনা চলছে।”
জঙ্গলমহল ছন্দে ফিরতেই গত তিন বছর ধরে পর্যটকদের ঢল নামছে মুকুটমণিপুরে। কিন্তু সেই ভিড় এখনও এসে পৌঁছয়নি ছেন্দাপাথরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy