দুই ছবি। বৃষ্টির অভাবে ঝালদার ডাঙা (উঁচু) জমিতে চাষই শুরু হয়নি। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
অগস্টের প্রথম সপ্তাহ ফুরোল। কিন্তু, পুরুলিয়া তেমন বৃষ্টি পেল কই?
সেই জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শেষ মাঝারি বৃষ্টি পেয়েছিল এই জেলা। তার পর থেকে আকাশে মেঘ জমলেই আশায় বুক বেঁধেছেন চাষিরা। কালো মেঘের আনাগোনা প্রায়ই হয়েছে। কোথাও টিপটিপ, কোথাও বা এক পশলা আবার কোনও কোনও এলাকা ছিটেফোঁটাও বৃষ্টি পায়নি। যে জেলার চাষ একান্ত ভাবেই বর্ষা-নির্ভর, সেই পুরুলিয়ায় বৃষ্টির এমন খেয়ালি আচরণে তাই চাষিদের মুখে ঘনীভূত হয়েছে আশঙ্কার মেঘ। জেলার বহু জায়গায় এখনও ধান চাষ শুরুই করতে পারেননি চাষিরা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, জেলার প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের কমবেশি ৮০ শতাংশই নির্ভর করেন বর্ষার মরসুমের আমন চাষের উপরে। এঁদের বেশির ভাগের জীবিকা বলতে আমন চাষ। কিন্তু, বৃষ্টির অভাবে এখনও অবধি (অগস্টের প্রথম সপ্তাহ) কমবেশি ১৫ শতাংশ চাষ হয়েছে। এই হিসেব জেলা কৃষি দফতরেরই। চাষ বলতে ধান রোঁয়া অর্থাত্ চারা তুলে বীজতলা তৈরি করে লাগানো। চাষিরা জানাচ্ছেন, স্বাভাবিক বৃষ্টি পেলে অগস্টের প্রথম সপ্তাহ অবধি জেলার বেশির ভাগ এলাকাতেই অন্তত ৮০ শতাংশ চাষ হয়ে যায়. এ বার কার্যত উল্টো ছবি। পুরুলিয়া ২ ব্লকের ডুবকিডি গ্রামের চাষি রাসবিহারী মাহাতো বললেন, “আমার ১৫ বিঘা জমি রয়েছে। তার মধ্যে বিঘা পাঁচেক নিচু জমি (বহাল)। সেই খেতগুলিতে কোনও রকমে ধান রোঁয়ার কাজ করতে পেরেছি। বাকি জমিতে তো জলই নেই! চাষ হবে কী করে?” একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ওই ব্লকেরই ন’ডিহা গ্রামের নিরঞ্জন মাহাতো। তাঁর কথায়, “জলের অভাবে রোঁয়ার কাজ করতে পারিনি।” কাশীপুর ব্লকের পাড়াশোল গ্রামের কৃষিজীবী যুধিষ্ঠির মাহাতো বলেন, “ভাল বৃষ্টি হলে এ সময় পর্যন্ত ৭০-৭৫ ভাগ চাষ হয়ে যায়। এ বার অবস্থা বেশ খারাপ। কোনও পুকুর বা নালা থেকে পাম্পে জল তুলে যে জমিতে বীজতলা তৈরির কাজ করব, তারও তো উপায় নেই। কেন না পুকুরেও তো জল নেই।”
দুই ছবি। পুরুলিয়া ২ ব্লকের সুরুলিয়ায় অল্প হলেও বীজতলার কাজ চলছে। ছবি: সুজিত মাহাতো।
জল নেই, কারণ বৃষ্টি নেই। এই মরসুমের আমন চাষের জন্য চাষিরা মূলত জুন-জুলাইয়ের বৃষ্টির উপরে নির্ভর করেন। জেলা কৃষি দফতরের হিসেব মোতাবেক এ বার জুনে ১৬৫.২৭ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ২৫২.১৯ মিলিমিটার এবং অগস্টে (৬ তারিখ পর্যন্ত) ৩৬.২৭ মিলিমিটার বৃষ্টি পেয়েছে পুরুলিয়া। জেলার গত ৩০ বছরের বৃষ্টির গড় হিসেব মোতাবেকও এ বার জেলা বষ্টি পেয়েছে অনেকটাই কম। সেই হিসাব অনুযায়ী, জুন, জুলাই ও অগস্টে গড়ে বৃষ্টি হয় যথাক্রমে ২৪৭.০৫ মিলিমিটার, ২৮৮.২৪ মিলিমিটার এবং ২৮২.৩৩ মিলিমিটার। জেলা কৃষি দফতরের এক কর্তা বলেন, “জুন-জুলাইয়ে (যেহেতু জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই চাষের মরসুমের বৃষ্টির হিসেব ধরা হয়ে থাকে) পুরুলিয়ায় গড়ে ৫৩৫.২৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। সেখানে এ বার এই দু’মাসে বৃষ্টি পেয়েছে ৪১৭.৪৬ মিলিমিটার। অর্থাত্, এ বার এখনও অবধি ২৩.০৭ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে।” কিন্তু জেলার ২ লক্ষ ৭২ হাজার হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে গড়ে কমবেশি ১৫ শতাংশ চাষ হয়েছে কেন? জেলার সহ কৃষি অধিকর্তা সুশান্ত দত্ত বলছেন, “চাষ হওয়ার জন্য একলপ্তে অন্তত ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি প্রয়োজন। পুরুলিয়ার মাটির জন্য এই পরিমাণ কোথাও কোথাও একটু বেশি হতে পারে। কিন্তু, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের পরে জেলা এক সঙ্গে এতটা বৃষ্টি পায়নি। কোথাও ঝিরঝির করে হয়েছে, কোথাও আর একটু বেশি। আবার মাঝে টানা কয়েক দিন বৃষ্টিহীন থেকেছে জেলা।”
আর বৃষ্টির এ হেন আচরণের জন্যই আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন এই জেলার চাষিরা। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের চাতরমহুল গ্রামের চাষি মনোজিত্ মাহাতো যে আশঙ্কার কথা শোনালেন, বস্তুত তা জেলার অধিকাংশ চাষিরই মনের কথা। মনোজিত্বাবুর কথায়, “এ বার কী হবে জানি না। অথচ বর্ষার সময়কার এই চাষটাই গোটা বছর আমাদের খাবারের বড় ভরসা।” জেলা এ রকম অবস্থা শেষ দেখেছিল ২০১০ সালে। সে বা মে থেকে সেপ্টেম্বরএই পাঁচ মাসে পুরুলিয়া বৃষ্টি পেয়েছিল মাত্র ৬২২ মিলিমিটার। এ বারও কি তিন বছর আগের সেই স্মৃতি ফিরে আসবে? প্রশ্নটা অনেক কৃষিজীবীর মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
জেলা কৃষি দফতরের উপ অধিকর্তা দিব্যেন্দু দাস বলেন, “অবস্থা যে ভাল নয়, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে অগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টি নামলে চাষ হয়ে যাবে। দেখা যাক কী হয়। আমরা আশাবাদী।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy