সাড়ে ছয় থেকে এক লাফে আঠারো! যা দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে অনেকেরই।
প্রায় তিন গুন বৃদ্ধির এই হার বীরভূমে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শতাংশের। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলকে বহু পিছনে ফেলে এ বারের লোকসভা ভোটের হিসেবে এমনটাই শক্তি সঞ্চয় করেছে বিজেপি। জেলায় বামেদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে রাজ্যের শাসক দলের প্রধান বিরোধী দল রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলপ্রকাশের পর থেকেই তাই দেখা যাচ্ছে তৃণমূল-বিরোধী শিবিরে যোগ দিতে বহু বাম কর্মী-সমর্থকও বিজেপিতে নাম লেখাচ্ছেন। উৎসাহিত বিজেপি নেতৃত্বে জেলা জুড়ে নানা কর্মসূচিও শুরু করে দিয়েছেন। কিছু নতুন এলাকায় দলীয় পতাকা-ফেস্টুনও নজরে পড়ছে। এমনকী, শাসক দলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে রীতিমতো হুঙ্কার দিচ্ছেন বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলও!
এই জেলায় বিজেপি এত জোর পাচ্ছে কীভাবে?
এক সময় ময়ূরেশ্বর, লাভপুর, রামপুরহাট ও সিউড়ি লাগোয়া গুটি কয়েক এলাকা ছাড়া বীরভূমে বিজেপির কোনও অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ২০০৯ সালের পর থেকে সিপিএম তথা বামফ্রন্টই ছিল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু গত বিধানসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে বামেরা কার্যত পিছনের সারিতে চলে যায়। ওই দু’টি নির্বাচনেও জেলায় বিজেপিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোট হিসেবের পাশা উল্টে দিয়েছে। দেশ জুড়ে প্রবল বিজেপি হওয়াকে কাজে লাগিয়ে গত লোকসভা ভোটের ফলে এই প্রথম বীরভূমে বিজেপি এত ভাল ফল করে। তারা একটি আসনেও জয়ী হয়নি, কিন্তু বিধানসভা ভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের হিসেবের দিকে তাকিয়ে অশনিসঙ্কেত দেখছে তৃণমূল। সুখে নেই বাম নেতৃত্বও। তাঁদের হাত থেকে প্রধান বিরোধী দলের ব্যাটনটিও ছিনিয়ে নিতে প্রবল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর দল। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকেই স্বীকার করছেন, “গত বিধানসভা, পঞ্চায়েত এমনকী সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটেও বিজেপি একটা বড় অংশের বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি। কিন্তু মানুষের একটা বড় অংশই তাদের সমর্থন করেছেন। ২০১৬ সালে বিজেপিই আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হতে চলেছে। ওদের এই উত্থান আমাদের মুশকিলে ফেলতেই পারে!”
এমন উল্টো হাওয়ায় সব থেকে চাপে জেলার বাম দলগুলি। সর্বত্র মার খেতে খেতে অনেকেই নিরাপত্তা পেতে বিজেপিতেই নাম লেখাচ্ছেন বলে খবর। ফলপ্রকাশের পর থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় এমন কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপিতে যোগদান করেছেন। এমনকী, সিপিএম ছেড়ে নরেন্দ্র মোদীর হাত শক্ত করেছেন এক জেলা কমিটির সদস্যও। দেখা যাচ্ছে, জেলার যে সব জায়গায় বিজেপির অস্তিত্বই ছিল না, ওই সব এলাকাও রাতারাতি বিজেপির ফ্লেক্স, ফেস্টুন ও মোদীর কাটআউটে ছেয়ে যায়। বেশ কিছু নতুন পার্টি অফিসও গড়ে উঠেছে। জেলার রাজনৈতিক চিত্রের এই বদলের অন্য ফলও দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে জেলায় শাসকদল তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ময়ূরেশ্বর, লাভপুর, দুবরাজপুর প্রভৃতি এলাকায় বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উপরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে হামলা, লুটপাঠ এবং বাড়িতে আগুন লাগানোর অভিযোগও উঠেছে। নতুন উদ্যম পাওয়া বিজেপি প্রতিরোধ গড়ে তোলারও চেষ্টা করছে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল, অনুব্রতর সুরে দুধকুমারের ‘গোটা পাড়া আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার’ রণহুঙ্কার বলে বিশ্লেষণ রাজনৈতিক মহলের।
রাজনৈতিক মহলের আরও মত, ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ বামেদের এক সময়ের এই নীতিও বিজেপিকে শক্তিশালী করে তুলেছে। গত বিধানসভা, পঞ্চায়েত ও সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে কার্যত ব্রাত্য হয়ে যাওয়া সিপিএম তথা ফ্রন্টের কাছে তৃণমূলই প্রধান প্রতিপক্ষ। কেন্দ্রে আসীন হওয়ার পরে বিজেপির রাজ্যে এই প্রভাব বিস্তার আবার তৃণমূলের চক্ষুশূল। দলের নিচুতলার কর্মীদের দাবি, জেলার একটা বড় অংশে সিপিএম ইতিমধ্যেই ‘গর্তে’ ঢুকে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাম দলগুলির নেতারা না পারছেন কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে, না পারছেন মিথ্যা মামলায় পুলিশি হেনস্থার হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করতে। এমনকী, তৃণমূলের আমলে ওই চিহ্নিত কর্মী-সমর্থকেরা বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। পরিবর্তনের পরে ‘আত্মরক্ষা’র তাগিদে নেতৃত্বের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই যাঁরা এত দিন সিপিএমকে প্রাণ দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিলেন, সেই তাঁদেরই একটা বড় অংশ তৃণমূলে নাম লেখাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, যাঁরা তার পরেও সিপিএমের সঙ্গে ছিলেন, সাম্প্রতিক ভোটের ফলাফলে হতাশ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে তাঁরাও এ বার দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করেছেন।
গত তিন বছরে জেলায় সিপিএম এবং তার শরিক দলগুলির বহু পার্টি অফিসই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় দীর্ঘ দিন কোনও সাংগঠনিক কর্মসূচিও করা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে মরিয়া চেষ্টায় নয়া কৌশল নিয়েছেন। সিপিএমেরই একটি সূত্রের দাবি, স্থানীয় নেতৃত্ব পরোক্ষে কর্মী-সমর্থকদের বিজেপিতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বাম নেতাদের ধারণা, কেন্দ্রীয় সরকারে থাকায় বিজেপি তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দিতে পারবে। আবার তাঁদের কর্মী-সমর্থক এবং বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের যৌথ শক্তিতে তৃণমূলকেও কোণঠাসা করা যাবে। পরে সাম্প্রদায়িকতার ‘জুজু’ দেখিয়ে সংখ্যালঘু কর্মী-সমর্থক-সহ অন্যান্যদের দলে ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ‘স্ট্র্যাটেজি’ নেওয়া হবে। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার হিড়িক প্রসঙ্গে অন্য আর একটি অংশের আবার অভিমত, বিজেপির অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ বিজেপিতে নাম লিখিয়ে আনুগত্য প্রদর্শনের মরিয়া চেষ্টা চালাছেন।
এ দিকে, বামফ্রন্টের কৌশলকে টেক্কা দিতে পিছিয়ে নেই তৃণমূলও। বিজেপির বাড়বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা আবার সিপিএমকে টিকিয়ে রাখার কৌশল নিচ্ছে। তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অশোক ঘোষ, ময়ূরেশ্বরের ঢেকা অঞ্চল কমিটির যুব সভাপতি প্লাবন মণ্ডলরা তো খোলাখুলিই বলছেন, “সিপিএম এখন নির্বিষ হয়ে পড়েছে। কোনও দিন আর ফণা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। বিজেপি এখন আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের দলে ভিড়িয়ে বিজেপি নিজের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। তাই বিজেপির প্রভাব রুখতে আমরা সিপিএমকে একটু ছাড় দিয়েছি। মিটিং, মিছিল কিংবা দলীয় কার্যালয় খুলে ওই কর্মী-সমর্তকেরা তারা যাতে সিপিএমেই টিকে থাকেন, তার জন্য পরোক্ষে উৎসাহ জোগাচ্ছি।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের উৎসাহ দেওয়ার কথাকে ভিত্তিহীন বলেই দাবি করেছেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, “তৃণমূল আর বিজেপি দু’দলই আমাদের শত্রু। তাই নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের বিজেপিতে যোগ দিতে পরামর্শ দেওয়ার প্রশ্নই আসছে না। তবে, কেউ কেউ আমাদের দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন বলে শুনেছি। কী কারণে তাঁরা দলত্যাগ করছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” আবার তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল জানিয়েছেন, বিজেপিকে রুখতে সিপিএমকে টিকিয়ে রাখতে দলের মদত জোগানোর কোনও প্রশ্নই নেই। তাঁর কথায়, “সিপিএম-বিজেপির এই জেলায় এখন কার্যত সংগঠনই নেই। তাই কারা কোন দল ছেড়ে কোন দলে যোগ দিল, তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই।”
অন্য দিকে, দুধকুমার বলছেন, “তৃণমূল বা সিপিএমের মুখাপেক্ষী হয়ে আমরা দল করি না। কারা তাদের কর্মী-সমর্থকদের আমাদের দলে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, তা-ও জানি না। তৃণমূলের সন্ত্রাসে সিপিএম তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্রে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেকেই ভরসা পেয়েছেন। সে কারণেই আমাদের দলে তারা যোগ দিচ্ছেন।” আগামী বিধানসভা ভোটে জেলার অধিকাংশ আসনই বিজেপি দখল করবে বলে তিনি দাবি করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy