Advertisement
০২ মে ২০২৪
অভিযোগ বালি ব্যবসায়ীর

তৃণমূলের বাধায় শালবুনিতে বন্ধ বালিঘাট

গাঁটের কড়ি খরচ করে সরকারি অনুমোদন জোগাড় করেছেন। তার পরেও তোলা না দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এক ব্যবসায়ীকে বালিঘাট থেকে বালি তুলতে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ। উল্টে ওই বাসিন্দারাই সেখান থেকে অবৈধ ভাবে বালি তুলছেন। তার জেরে ইতিমধ্যেই ওই ব্যবসায়ীর কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতিও হয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীর আরও দাবি, তৃণমূলের মদতেই তাঁর কর্মীদের ওই বাসিন্দারা বালি তুলতে বাধা দিচ্ছেন। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও গত তিন মাস ধরে তিনি বালি তুলতে পারছেন না।

বিতর্কিত বালিঘাট। —নিজস্ব চিত্র

বিতর্কিত বালিঘাট। —নিজস্ব চিত্র

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৯
Share: Save:

গাঁটের কড়ি খরচ করে সরকারি অনুমোদন জোগাড় করেছেন। তার পরেও তোলা না দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এক ব্যবসায়ীকে বালিঘাট থেকে বালি তুলতে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ। উল্টে ওই বাসিন্দারাই সেখান থেকে অবৈধ ভাবে বালি তুলছেন। তার জেরে ইতিমধ্যেই ওই ব্যবসায়ীর কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতিও হয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীর আরও দাবি, তৃণমূলের মদতেই তাঁর কর্মীদের ওই বাসিন্দারা বালি তুলতে বাধা দিচ্ছেন। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও গত তিন মাস ধরে তিনি বালি তুলতে পারছেন না।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গত অগস্ট মাসে আব্দুল হামিদ নামে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের ওই ব্যবসায়ী রামপুরহাট থানার শালবুনি গ্রাম লাগোয়া ব্রাহ্মণী নদীর উপরে বালিঘাট থেকে বালি তোলার জন্য সেচ দফতরের ময়ূরাক্ষী উত্তর ক্যানাল বিভাগে আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে তিনি শালবুনি গ্রামের ২৮৭ দাগে গ্রামের নিচুপাড়া কালীতলা এলাকায় বালি তোলার অনুমোদন পান। আগামী তিন মাসের হিসেবে রাজস্ব বাবদ ওই ব্যবসায়ী তিন লক্ষ সিএফটি বালির জন্য ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৬৮০ টাকা এবং অন্যান্য সরকারি ফি জমা দিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও হামিদ ওই বালিঘাট থেকে এক সিএফটি বালিও তুলতে পারেননি বলে অভিযোগ। এমনকী, বালিঘাট পরিদর্শনে গেলে সেচ দফতরের আধিকারিকদেরও বাসিন্দারা বাধা দেন। ব্যবসায়ীর দাবি, এখনও পর্যন্ত তাঁর ২৭ লক্ষের বেশি টাকা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।

গোটা ঘটনায় এ জেলার পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মুর্শিদাবাদের ওই ব্যবসায়ী। আব্দুল হামিদের অভিযোগ, “রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণির বালি মাফিয়ারা অবৈধ ভাবে বালি তুলছে। অথচ আমি সরকারের ঘরে এত টাকা দিয়েও ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছি না। তৃণমূলের মদতে গ্রামের কয়েক জন বালি তুলতে বাধা দিচ্ছেন।” তিনি জানান, সম্প্রতি ফের বালি তোলার চেষ্টা করতে গেলে এক চালককে মারধর করে রাতভর নির্যাতন করে ট্রাক ভাঙচুর করা হয়। হামিদের দাবি, “বালি তোলার জন্য ওরা আমার কাছ থেকে প্রতি মাসে গেলে ৭ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা তোলা চেয়েছিল। আমি তা দিতে অস্বীকার করি। তার জেরেই আমার সঙ্গে এই সব হচ্ছে। অথচ ইতিমধ্যেই আমার ৮০ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছি।”

বুধবার সকালে এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ওই ঘাটে, আব্দুল হামিদের মাসিক কিস্তিতে কেনা বালি তোলার যন্ত্র পড়ে রয়েছে। সেটি আগলে হামিদের পাঁচ কর্মী গত এক মাস ধরে একটি অস্থায়ী ঘরে বাস করছেন। নদীর ঘাটে দু’জায়গায় বালি উঁচু করে জড়ো করা আছে। বালিঘাটেই বক্রেশ্বর মাহাতো, মেঘলাল ঘোষ, শ্রীকান্ত মাহাতো, সত্যবান মাহাতো, বিপ্লব মাহাতো-সহ শালবুনির জনা পঞ্চাশেক বাসিন্দা জটলা করছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ওই বালি ব্যবসায়ীর অভিযোগের সত্যতা অনেকটাই মিলেছে। তাঁদের বক্তব্য, “এলাকায় খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। এই মুহূর্তে পঞ্চায়েত থেকে একশো দিনের কাজ বন্ধ আছে। এখানে বালি তোলার কাজ শুরু হলে এলাকার শ্রমিকেরা দৈনিক ২০০ টাকারও বেশি আয় করতে পারবেন।” তাঁদের অভিযোগ, “গ্রামের তৃণমূল নেতারা সেটা চাইছেন না। মুষ্টিমেয় কয়েক জনের জন্য আমাদের গ্রামের বেকার যুবকেরা খেটে দু’পয়সা আয় করতে পারছেন না।”

এ দিকে, গ্রামের আর এক বাসিন্দা রুমালি রাহুত দাবি করলেন, এর আগেও তৃণমূলের কিছু নেতা গ্রামে শিবমন্দির তৈরির অজুহাতে বালিঘাট থেকে বালি তুলে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “আমি মন্দির নির্মাণ কমিটির সদস্য হিসেবে বালি বিক্রির টাকার হিসেব চেয়েছিলাম। ওরা তখন আমাকেই কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দেয়।” শুধু তা-ই নয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভাবেই বালিঘাট থেকে বালি চুরির অভিযোগ উঠছে। বিপ্লব মাহাতো, শ্রীকান্ত মাহাতোদের দাবি, “গ্রামের স্কুল লাগোয়া বালিঘাট থেকে ওরা খেয়াল খুশি মতো বালি তুলছে। আর এক জন যিনি সরকারের ঘরে রাজস্ব জমা দিয়েছেন, তাকে ওরা বালি তুলতে বাধা দিচ্ছে। ট্রাকে ভাঙচুর চালাচ্ছে, বালি তোলার যন্ত্রে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।”

বালি তুলতে বাধা দেওয়ার কথা মেনে নিলেও তোলা চাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মী সন্তোষ মাহাতো, বাসুকি মাহাতো, অমিত মাহাতো, সুদেশ্বর মাহাতোরা। তাঁদের বক্তব্য, “গ্রামের রাস্তা খারাপ। আমরা বড় গাড়ি ঢুকতে দেব না। ট্রাক্টরে বালি তুললে আপত্তি নেই। তা ছাড়া গ্রামের মহিলারা ওই বালিঘাটে গৃহস্থালির কাজ করেন। সেই জন্য আমরা কালীতলার ঘাটে বালি তুলতে বাধা দিয়েছি।” এ দিকে, ওই তৃণমূল কর্মীদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন সংশ্লিষ্ট নারায়ণপুর পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্য তথা ওই এলাকার তৃণমূল নেতা লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো। তাঁর বক্তব্য, “গ্রামবাসীদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই আব্দুল হামিদ ব্যবসা করতে নেমেছেন। ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই হামিদের ব্যবসা করতে আসা উচিত ছিল।”

ঘটনায় ব্যবসায়ীকেই দুষছেন রামপুরহাটের বিধায়ক তথা রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “তৃণমূলের নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। অতীতে এক বাসিন্দার ডুবে যাওয়ার জেরে ওই বালিঘাটে বালি তোলায় বাসিন্দাদের আপত্তি রয়েছে।” তৃণমূল নেতাদের এই বক্তব্যে ক্ষোভ বেড়েছে হামিদের। তাঁর প্রশ্ন, “নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে টাকা দিয়ে বৈধ ভাবে বালি তোলার অনুমতি পেয়েছি। সরকারই ওই ঘাট থেকে বালি তোলার অনুমতি দিয়েছে। যদি এটাই যদি মূল সমস্যা, তা হলে প্রশাসন ওখানে বালিঘাটের অনুমোদন কেন দিচ্ছে?” তাঁর দাবি, বাসিন্দাদের আপত্তির কথা তৃণমূলের নেতাদের বানানো। তা না হলে বিশেষ কয়েক জন ওই এলাকা থেকে অবৈধ ভাবে বালি তুলতে পারতেন না। এলাকার তৃণমূল নেতাদের তোলা দিতে আপত্তি করাতেই বালি তুলতে বাধা দেওয়ার মূল কারণ বলে ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ।

ওই বালি ব্যবসায়ীর অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি ময়ূরাক্ষী উত্তর ক্যানালের রামপুরহাট শাখার রেভিনিউ অফিসার সৌমাভ ভট্টাচার্য। তবে, দফতরের নির্বাহী আধিকারিক সুজিত কোনার বলেন, “বিষয়টি জানি। কী করা যায় দেখছি।” অন্য দিকে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “শালবুনি এলাকায় বালি তোলা নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছিল। ঠিক কী হয়েছে, খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ করব।” একই আশ্বাদ এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও-এরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

apurba chattopadhyay rampurhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE