Advertisement
০২ মে ২০২৪
হামলায় অভিযুক্তেরা কেন অধরা, ক্ষোভ তৃণমূলে

দুর্ভোগে ফেলে কর্মবিরতি শুরু পাত্রসায়রে

অনুরোধ-আবেদনে কাজ হয়নি। দলের জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে জুটেছে ‘উপেক্ষা’। প্রতিবাদে এ বার কর্মবিরতি শুরু হল পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতি ও তার অন্তর্গত ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে। আর তার ফলে দুর্ভোগে পড়ল আম-জনতা। এই কর্মবিরতিও পাত্রসায়রে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণাম বলেই জানা যাচ্ছে।

পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষের অফিস ঘরে ঝুলছে তালা। —নিজস্ব চিত্র

পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষের অফিস ঘরে ঝুলছে তালা। —নিজস্ব চিত্র

দেবব্রত দাস
পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

অনুরোধ-আবেদনে কাজ হয়নি। দলের জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকে জুটেছে ‘উপেক্ষা’। প্রতিবাদে এ বার কর্মবিরতি শুরু হল পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতি ও তার অন্তর্গত ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতে। আর তার ফলে দুর্ভোগে পড়ল আম-জনতা। এই কর্মবিরতিও পাত্রসায়রে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিণাম বলেই জানা যাচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পাত্রসায়র ব্লক অফিসের ভিতরে ব্লক সংসদের সভা চলাকালীন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, দুই কর্মাধ্যক্ষকে মারধর, অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। প্রশাসনও নীরব। এত বড় ঘটনার পরেও তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। এ সবেরই প্রতিবাদে পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েতগুলিতে কর্মবিরতি শুরু করেছেন তৃণমূলের একাংশ। মঙ্গলবার থেকে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষেরা এবং পাত্রসায়র, বালসি-২, বিউর-বেতুড়, বীরসিংহ, জামকুড়ি ও কুশদ্বীপ পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান-সহ জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের অফিসে আসবেন না বলে বিডিও-র কাছে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, এ বার হয়তো তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব এবং পুলিশ-প্রশাসনের টনক নড়বে!

এই কর্মবিরতির জেরে উন্নয়ন-সহ দৈনন্দিন কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে আচমকা এই কর্মবিরতির ফলে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “বিডিও-র উপস্থিতিতে ব্লক সংসদের বার্ষিক সভায় আমাদের মারধর করা হয়েছে। বহিরাগত দুষ্কৃতীদের সঙ্গে নিয়ে বাবলু সিংহ, গোপে দত্ত সহ দলেরই কয়েক জন গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেছে! এই ঘটনায় গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ সদস্য নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।” সে জন্যই ব্লকের ৬টি পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান এবং পঞ্চায়েত সমিতির সিংহভাগ সদস্য সর্বসম্মতিক্রমে মঙ্গলবার থেকে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সমস্ত কাজকর্ম থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান দিলীপবাবু। তাঁর কথায়, “৬টি পঞ্চায়েতের প্রধান এবং আমি লিখিত ভাবে বিডিও-কে এই কর্মবিরতির কথা জানিয়ে দিয়েছি।” পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সুচাঁদ দাসের দাবি, “ব্লক অফিসের ভিতরে এত বড় ঘটনার পরেও পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। বিডিও একটা দায়সারা অভিযোগ করে নিজের দায় এড়াতে ব্যস্ত। উল্টে তিনি আমাদের উপরে হাময়া অভিযুক্তদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এ সবের প্রতিবাদে আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কর্মবিরতি শুরু করতে বাধ্য হয়েছি।”

পাত্রসায়রের বিডিও অপূর্বকুমার বিশ্বাস বলেন, “ওই দিন যা ঘটেছে, তা আমার চাকরি জীবনে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছিলাম। পরে অবশ্য পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।” অভিযুক্ত বাবলু সিংহ, গোপে দত্তরা যে ঘটনার পরে তাঁর কাছে এসেছিলেন, সেটা মেনে নিয়েও বিডিও-র দাবি, “ব্লক অফিসের মধ্যেই পুলিশ কয়েক জনকে মারধর করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমার কাছে দরবার করেন ওঁরা। এর বেশি কিছু আলোচনা হয়নি।”

রাজনৈতিক সমীকরণে পাত্রসায়র ব্লকের ১০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টিতে ক্ষমতার রাশ ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায়ের গোষ্ঠীর হাতে। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ক্ষমতাসীন স্নেহেশবাবুর অনুগামীরা। এই কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন স্নেহেশবাবুর শিবিরের নেতারাই। যে ৬টি পঞ্চায়েতে কর্মবিরতি শুরু হয়েছে, সেগুলি স্নেহেশ-গোষ্ঠীর দখলে।

কর্মবিরতির জেরে চরম হয়রানির শিকার হতে শুরু করেছেন বিভিন্ন প্রয়োজনে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতে আসা মানুষজন। এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ পাত্রসায়র ব্লক অফিসে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় সুনসান অফিস চত্বর। পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে সভাপতির ঘর বন্ধ। কর্মাধ্যক্ষদের ঘরেও তালা ঝুলছে। ব্লকের এক কর্মী জানিয়ে দিলেন, “অন্য দিন ১১টার আগেই সভাপতি অফিসে চলে আসেন। কর্মাধ্যক্ষেরাও ১১টার আগে পরে চলে আসেন। এ দিন কেউই আসেননি। তাঁরা এখন কিছুদিন অফিসে আসবেন না বলে শুনছি।” পঞ্চায়েত সমিতির অফিস থেকে বের হতেই দেখা হল বরুজপোতা গ্রামের বাসিন্দা আলিমা বিবির সঙ্গে। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ব্লক অফিসে এসেছিলেন বার্ষিক আয়ের শংসাপত্র নিতে। তিনি বললেন, “জামকুড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান এ দিন শংসাপত্র দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেওয়ায় ব্লকে এসেছিলাম। এখানে এসেও দেখছি সভাপতি নেই। একটা শংসাপত্রের জন্য এত দূর থেকে এখানে এসেও হয়রানির মুখে পড়তে হল।”

পাত্রসায়র গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে একই ছবি। পঞ্চায়েত অফিসে কর্মীরা রয়েছেন। কিন্তু প্রধান, উপপ্রধান কেউ নেই। পঞ্চায়েতের এক কর্মী বললেন, “প্রধান, উপপ্রধান এখন আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা প্রধানের কাছে আসছেন, অথচ প্রধানকে পাচ্ছেন না, তাঁদেরকে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।” পাত্রসায়রের কর্মকারপাড়ার বাসিন্দা সন্ধ্যা কর্মকার বলেন, “বিধবা ভাতার জন্য দরখাস্ত জমা দিতে এসেছিলাম প্রধানের কাছে। জানতাম না উনি নেই। ফলে দরখাস্ত কেউ আর জমা নিল না।” পাত্রসায়র স্টেশনের বাসিন্দা তপন মল্লের ক্ষোভ, “মেয়ের কন্যাশ্রীর জন্য একটা শংসাপত্র জরুরি ছিল। সে জন্য পঞ্চায়েতে এসেছিলাম। কিন্তু পেলাম না। এখন বিডিও-র কাছ থেকে শংসাপত্র নিতে হবে।”

স্নেহেশবাবু এই কর্মবিরতি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর অনুগামী ব্লক তৃণমূল নেতা জিয়ারুল ইসলামের দাবি, “এই কর্মবিরতির জন্য সাধারণ মানুষের কিছুটা অসুবিধা হবে এটা সত্যি। কিন্তু ব্লক অফিসের ভিতরে ওই দিন যে ন্যক্কারজনক কাণ্ড ঘটেছে, তার প্রতিবাদ জরুরি। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষেরা এবং ৬টি পঞ্চায়েতের প্রধানরা বাধ্য হয়েই আলোচনার পরে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। তোলাবাজদের বিরুদ্ধে এ ছাড়া প্রতিবাদের আর কোনও পথ ছিল না।”

বস্তুত, ঘটনার এত দিন পরেও অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মী গোপে দত্ত, বাবলু সিংহদের বিরুদ্ধে দলের জেলা নেতৃত্ব ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে। তৃণমূলের একটি বড় অংশ দল ছাড়তে পারেন বলেও একটি সূত্রের খবর। পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূলের এক নেতার হুঁশিয়ারি, “স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দলের মধ্যে ভাঙন এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। জেলা নেতৃত্ব কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা আর কিছুদিন দেখব। তার পরে চরম সিদ্ধান্ত নেব।”

জেলা নেতৃত্ব কেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারছেন না? তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলার সভাপতি অরূপ খাঁ-এর মোবাইল বেজে গিয়েছে। তিনি ফোন ধরেননি। বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী অবশ্য বলেছেন, “পাত্রসায়র পঞ্চায়েত সমিতি ও ৬টি পঞ্চায়েতে কর্মবিরতি চলছে বলে আমার জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।”

পুলিশের ভূমিকাতেও ক্ষোভ ছড়িয়েছে স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, খুনের চেষ্টা, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর সহ বিভিন্ন জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা শুরু হলেও পুলিশ অভিযুক্তদের ধরছে না। তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশকুমার ঘটনার পরের দিন বলেছিলেন, ‘তদন্ত করে অভিযুক্তদের সকলকে ধরা হবে’। সেই আশ্বাসের পরে পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কাউকে ধরেনি। এ দিনও পুলিশ সুপার বলেন, “ওই ঘটনার তদন্ত চলছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE