Advertisement
E-Paper

পুরুলিয়ার বালি পাচার ঝাড়খণ্ডে

পথে বেড়িয়ে মাঝে মধ্যেই বালির ট্রাক ও ডাম্পার থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করেন জেলা সভাধিপতি। পুলিশকে ফোন করে কখনও সখনও তিনি বেআইনি ভাবে বালি পরিবহণের অভিযোগে কিছু ট্রাক আটক করিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই শাসকদলের নেতৃত্বও অভিযোগ করেছেন, সুবর্ণরেখা নদীতে বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় কুমারী নদী থেকে বালি ঝাড়খণ্ডে পাচার করা হচ্ছে। ভিন্ রাজ্যে বালি পাঠানো বেআইনি জেনেও পুলিশ কিছু করে না বলেই বিভিন্ন মহলে অভিযোগ। তবুও পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারের দাবি, “ভিন্ রাজ্যে বালি পাচার প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

সমীর দত্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০০:০৯
চলছে বালি পাচার।—ফাইল চিত্র

চলছে বালি পাচার।—ফাইল চিত্র

পথে বেড়িয়ে মাঝে মধ্যেই বালির ট্রাক ও ডাম্পার থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করেন জেলা সভাধিপতি। পুলিশকে ফোন করে কখনও সখনও তিনি বেআইনি ভাবে বালি পরিবহণের অভিযোগে কিছু ট্রাক আটক করিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই শাসকদলের নেতৃত্বও অভিযোগ করেছেন, সুবর্ণরেখা নদীতে বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় কুমারী নদী থেকে বালি ঝাড়খণ্ডে পাচার করা হচ্ছে। ভিন্ রাজ্যে বালি পাঠানো বেআইনি জেনেও পুলিশ কিছু করে না বলেই বিভিন্ন মহলে অভিযোগ। তবুও পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারের দাবি, “ভিন্ রাজ্যে বালি পাচার প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

বাস্তব ছবিটা কেমন? ২১ মে রাত ১০টা। বরাবাজার-মানবাজার রাস্তা ধরে জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো তার বলরামপুরের বাড়িতে ফিরছিলেন। বরাবাজারের সিন্দরি গ্রামে সারি দিয়ে চলা বালিভর্তি ডাম্পার দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দেহরক্ষীদের দিয়ে তিনি ডাম্পারগুলি থামিয়ে কাগজপত্র যাচাই করেন। বরাবাজার ও বোরো থানা এলাকার সীমানা থেকে কুমারী নদীর কয়েকটি ঘাট থেকে বালি তুলে জামশেদপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পরীক্ষা চলাকালীন অন্ধকারের সুযোগে বেশির ভাগ ডাম্পার চালক পালিয়ে যান। নথি পরীক্ষা করে সভাধিপতির মনে হয়েছিল নথিতে অসঙ্গতি রয়েছে এবং গাড়িগুলি ওভারলোড রয়েছে। তিনি পুলিশকে ফোন করে খবর দেন। পরে পুলিশ জানায়, ২০টি গাড়ির মধ্যে ১৬টি গাড়িতেই নথিপত্রে অসঙ্গতি ছিল।

এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে মানবাজার-বান্দোয়ান রাস্তা ধরে সকালে পার হচ্ছিলেন সভাধিপতি। বোরো থানার খড়িদুয়ারা গ্রামের কাছে সারি দেওয়া বালিভর্তি ডাম্পার দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। তিনি পুলিশকে জানান। ২৪ ফেব্রুয়ারি বরাবাজারের সিন্দরি গ্রামে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতে অসুবিধা হওয়ায় বাসিন্দারা ১৬টি বালিভর্তি ডাম্পার আটক করেছিলেন। বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এই অবস্থায় ডাম্পারগুলি যানজট বাড়িয়ে তুলছে।

ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া পুরুলিয়ার বোরো, বান্দোয়ান, বরাবাজার প্রভৃতি থানা এলাকায় থেকে বালি তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা অবৈধ ভাবে বালি পাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সরব হয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “ভিন্ রাজ্যে বালি পাচার হতে দেওয়া যাবে না। স্থানীয় নেতাদের বলেছি অবৈধ ভাবে বালি পাচার হচ্ছে দেখলে পুলিশকে খবর দিন।”

তারপরেও বালি পাচার বন্ধ হয়নি কেন? বালি পাচারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট বরাবাজারের বাসিন্দা তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য সুমিতা সিংহমল্ল। তিনি সরাসরি এর পিছনে পুলিশের একাংশের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর দাবি, “কয়েকবার বালির গাড়ি আটকের সময় ঘটনাচক্রে সভাধিপতির সঙ্গে ছিলাম। বালি পাচারকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশ রয়েছে। থানা থেকে চালকদের দেওয়া হয়েছে এরকম কয়েকটি স্লিপ চালকদের কাছ থেকে আমি উদ্ধার করেছি। এমনকী কয়েকজন চালক থানার সঙ্গে বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের হয়রান করা হচ্ছে, জানতে চেয়েছিলেন। যদিও পুলিশ সুপার এই অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “এমন অভিযোগ পেলে আমাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে জানান। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।”

অতিরিক্ত জেলা শাসক তথা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক মলয় হালদার বলেন, “ভিন্ রাজ্যে বালি পাঠানো বেআইনি। যাঁরা এই নিয়ম ভাঙছেন, তাদের জরিমানা করে মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্লক ভূমি সংস্কার আধিকারিকদের।” কিন্তু বন্ধ করা গিয়েছে কি? এ বার তাঁর স্বীকারোক্তি, “বালি ঘাটগুলোয় নজরদারি দেওয়ার মতো পরিকাঠামো কোথায়? তবু অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

কী ভাবে চলছে বালি পাচার? কিছু জায়গায় শ্রমিকরা বেলচা নিয়ে বালি তুলছে। আবার অনেক জায়গায় রীতিমতো মেশিন নামিয়ে দ্রুত অনেক পরিমাণ বালি কেটে ডাম্পারে তোলা হচ্ছে। শুধু দিনের বেলাই নয়, চাহিদা মেটাতে রাতেও বালি তোলার সমানে চলছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় নেতা থেকে পুলিশকে জানিয়ে লাভ হয়নি। বালি তোলার ঘাটে অসাধু চক্রের লোকজনরা পাহারায় থাকে। তাদের ঠান্ডা চোখের চাউনি দেখে বাসিন্দারা ঝামেলা এড়াতে সরে যান। বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, প্রশাসনের একাংশ জড়িত না থাকলে এ ভাবে বুক ফুলিয়ে বালি পাচার হত না। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, বাম আমলে কিছু নেতা-কর্মীর সাহায্যে বরাবাজার, বান্দোয়ান, বোরো থানা এলাকা থেকে সাদা পাথর যে ভাবে পাচার করা হয়েছে, তৃণমূল সরকারের আমলেও একই ভাবে ভিন রাজ্যে বালি পাচার হচ্ছে।

বালি মাফিয়াদের নজর এখন লাগোয়া জেলার নদীগুলির উপর পড়েছে। জামসেদপুরের বালি নিয়ে যাওয়ার পথে এক ডাম্পার চালক জানান, গাড়ির তেল খরচ, স্থানীয় নেতা ও পুলিশকে ‘উপরি’ দেওয়ার পরেও এক ডাম্পার বালি জামসেদপুরে পৌঁছে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা লাভ থাকে। সারা দিনে দু’বার নিয়ে গেলে ২০ হাজার টাকা রোজগার। প্রতি গাড়ি মাসে প্রায় পাঁচ-ছয় লক্ষ টাকা আয় করে। সে কারণেই বালি মাফিয়ারা এখন পুরুলিয়ার বালি ঘাটগুলোকে নিশানা করেছে। বিষয়টি নিয়ে সৃষ্টিধরবাবু নিজেও যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি বলেন, “ডাম্পারগুলি শুধু বালি পাচার করছে এমন নয়। ৫০০ ঘন ফুট বালি তোলার অনুমতি থাকলে ৭০০ ঘন ফুট তোলা হচ্ছে। প্রতি ডাম্পারে ১৮ থেকে ২০ টনের বালি থাকছে। এ জন্য রাস্তাও ভাঙছে।”

illegal sand mines purulia jharkhand
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy