গরমে ধূ ধূ করছে নদীর উষ্ণ বালি। শীতে ঠান্ডা। আর বর্ষায় নদীতে ভর্তি জল থাকে। কিন্তু যোগাযোগের অন্য পথ না থাকায় এই প্রতিকুল পথই ভরসা নদী মাঝের ১০-১২টি গ্রামের। এই সমস্যার সমাধান করতে পারে শুধু একটি সেতু। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।
অথচ প্রতিটি ভোটের আগে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। ভোট ফুরোলে কারও দেখা মেলে না। এই কথাগুলি প্রযোজ্য নয় ময়ূরাক্ষী ও কানা নদীর মাঝে অবস্থিত সিউড়ি ১, মহম্মদবাজার ও সাঁইথিয়া ব্লকের দুমোহনি, মাঝিপাড়া, বেহিড়া, নরসিংহপুর, ঘাষবেড়া-সহ ১০-১২টি গ্রামের। কারণ এই গ্রামগুলিতে সে ভাবে প্রচারেও আসেন না উঁচু স্তরের নেতা মন্ত্রীরা। আর লোকসভা ভোটে? কবে কোন প্রার্থী বা ভোটের পরে কোন সাংসদ ও দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এসেছেন কি না ঠিক মনে করতে পারছেন না ওই সব গ্রামের অধিকাংশ মানুষজন। বাসিন্দাদের কথায়, “হয়তো হাজার পাঁচেক ভোটের জন্য কেউ এই দুর্গম রাস্তা ভাঙতে চাইছেন না।”
হয় তো এলাকাবাসীর এই ক্ষোভের কথা জানতে পেরে সম্প্রতি ওই গ্রামগুলিতে প্রচার করে এসেছেন বীরভূম কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। স্বাভাবিকভাবেই সকলের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। এই প্রথম কোনও এক বিদায়ী সাংসদ তথা প্রার্থীকে পেয়ে তাঁদের কিছু দাবিপত্র তুলে দিয়েছেন বাসিন্দারা। তাঁদের প্রধান দাবিটাই হল গ্রামগুলি থেকে বেরনোর জন্য একটি সেতু। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তা হলে অন্তত একটা কজওয়ে বা ফেরিঘাট তৈরি করে দেওয়া হোক।
সিউড়ি ১ ব্লকের দুমোহনি, মাঝিপাড়া, ভেজেনা, মহম্মদবাজারের বেহিড়া, নরসিংহপুর, পারশিমুলিয়া, শেওড়াবেরা, উপরবড়াম, নামোবড়াম, কাটুনিয়া, সাঁইথিয়ার ঘাষবেড়া, গোবিন্দপুর ও কুলতোড় এই গ্রামগুলির দুরবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামগুলির পাশ দিয়ে যাওয়া দু’টি নদীতে গরমে বা শীতে হাঁটু জল থাকে। কিন্তু বর্ষায় খরস্রোতা হয়ে পড়ে। অন্য সময় নদীর মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে খুব একটা বেগ না পেলেও বর্ষায় দুর্ভোগের শেষ থাকে না। গত বর্ষার সময় গোবিন্দপুর গ্রামের একটি মেয়ের বিয়ে ছিল। কনের বাবা শেখ আবুল কালাম বললেন, “পাত্রপক্ষ সকাল ৯টার সময় নদীর ওপারে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামে সরকারি বা বেসরকারি কোনও নৌকা নেই। গ্রামে আসার কোনও উপায় নেই। এ দিকে লগ্ন বয়ে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে গুড়ের কড়াই জোগাড় করে তাঁদের গ্রামে নিয়ে আসা হয়।” এই গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইরফান শেখ, ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মুখসুরা খাতুন, কলেজ পড়ুয়া জামালুদ্দিন, জাসমিনতারা খাতুনদের কথায়, “এই এলাকার ছেলেমেয়েরা যে কী কষ্ট করে পড়াশোনা করে, তা তারাই জানে। বলে বোঝানো যাবে না। অনেক সময় কাঁধে সাইকেল নিয়ে হাটু জল পার হতে হয়। আবার বৃষ্টি ও বন্যার সময় বহুদিন স্কুলকলেজ যাওয়া হয়ে ওঠে না। অনেকে যোগাযোগের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।”
গোবিন্দপুরের আসরফ আলি, মহম্মদ মুস্তাফা, কাটুনিয়ার দুলালচন্দ্র কর, বড়ামের বলরাম মণ্ডল, কুলতোড়ের সমীর পালরা বলেন, “আমাদের এলাকায় কোনও দিন কোনও সাংসদ এসেছিলেন কি না মনে করতে পারছি না। সাংসদ কেন? কোনও দলের লোকসভার প্রার্থী বা শীর্ষ নেতৃত্ব এসেছিলেন কি না তাও মনে করতে পারছি না।” আসরফ আলি তো বলেই দিলেন, “রামচন্দ্র ডোম ২০ বছর এলাকার সাংসদ ছিলেন। এলাকায় একবারের জন্য আসেননি এবং এই এলাকার জন্য কোন কাজ করেননি।” সম্প্রতি তাঁদের গ্রামে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী শতাব্দী রায় প্রচারে গিয়েছিলেন। এই প্রথম কোনও প্রার্থীকে দেখে আনন্দ চেপে রাখতে পারেননি ওই সব গ্রামের বাসিন্দারা। ওই দিন তৃণমূলে যোগ দেন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সিপিএমের কায়েম আলি। তিনি বলেন, “সত্যি বলতে এলাকার কোনও উন্নতিই হয়নি। ২০০৩-২০০৪ সালে জেলা পরিষদ থেকে ১.৫১ কোটি টাকা ব্যায়ে একটি সেতু নির্মাণের কথা হয়েছিল। ওই পর্যন্ত। শুধু যে সেতু হয়নি তা নয়, গ্রামের ভিতরের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খুব খারাপ।” শতাব্দী বলেন, “যদি একটা সেতু করে এই গ্রামগুলিকে সাজানো যায়, তা হলে একটা বেড়ানোর ভাল যায়গা হতে পারে। একটা কজওয়ের জন্য জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁরা। তারই একটা কপি আমাকে দিয়েছেন। আমার দ্বারা যতটা সম্ভব আমি চেষ্টা করব।” শেষ পর্যন্ত এই গ্রামগুলির অবস্থা পাল্টাবে কি না তা সময়ই বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy