Advertisement
০৭ মে ২০২৪
মন্যাডিতে শাসানি বাঁকুড়া জেলা সভাধিপতির

পুলিশ না ধরলে এফআইআর হবে: রাহুল

প্রকাশ্যে খুনের প্ররোচনা দেওয়ার পরে জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীকে গ্রেফতারের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে বাঁকুড়ায়। এক দিকে, প্ররোচনামূলক মন্তব্য করার পরেও কেন সভাধিপতিকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এই প্রশ্ন তুলে বুধবার পুলিশের তীব্র সমালোচনা করেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। সভাধিপতি তথা জেলা তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তাঁরাই পুলিশের কাছে এফআইআর করবেন বলেও জানিয়েছেন রাহুলবাবু।

বিষ্ণুপুরের লোখ্যাশোলে বিজেপিতে যোগ দিলেন বহু মানুষ। ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ।

বিষ্ণুপুরের লোখ্যাশোলে বিজেপিতে যোগ দিলেন বহু মানুষ। ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৪ ০০:২৯
Share: Save:

প্রকাশ্যে খুনের প্ররোচনা দেওয়ার পরে জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীকে গ্রেফতারের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে বাঁকুড়ায়।

এক দিকে, প্ররোচনামূলক মন্তব্য করার পরেও কেন সভাধিপতিকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এই প্রশ্ন তুলে বুধবার পুলিশের তীব্র সমালোচনা করেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। সভাধিপতি তথা জেলা তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তাঁরাই পুলিশের কাছে এফআইআর করবেন বলেও জানিয়েছেন রাহুলবাবু। এ দিনই বাঁকুড়া সদর থানায় স্মারকলিপি দিয়ে অরূপবাবুকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে বাম প্রভাবিত মহিলা সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা শাখা। একই দাবিতে এ দিন বড়জোড়ায় পথসভা করেছে সিপিএম-ও।

মঙ্গলবার সদর থানার মন্যাডি গ্রামে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন অরূপবাবু। পুলিশকর্মীদের উপস্থিতিতেই তিনি ওই সব পরিবারের মহিলাদের তাঁদের বাড়ি কেউ আক্রমণ করলে সরাসরি কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। মূলত এলাকার বিজেপি কর্মীরাই ছিলেন অরূপবাবুর শাসানির নিশানায়। সভাধিপতির ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্যে রাজ্য জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অরূপবাবুর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার দাবিতে সরব হন বিরোধীরা। যদিও পুলিশের তরফে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

মন্যাডি গ্রামে গত শনিবার তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ হয়। রবিবার গ্রামে ঘুরে যায় রাজ্য বিজেপি-র প্রতিনিধিদল। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে অরূপবাবু ওই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। মন্যাডির পরিবেশ থমথমে ছিল বুধবারও। শনিবারের সংঘর্ষের পর থেকেই গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য ছিল। এ বার সভাধিপতি গ্রামছাড়া তৃণমূল কর্মীদের নির্ভয়ে বাড়ি ফেরার অভয় দেওয়ায় এবং ও কেউ আক্রমণ করতে এলে ‘কেটে ফেলা’ বা ‘বলিদান’ করে দেওয়ার নিদান দেওয়ায় চাঙ্গা হয়ে উঠেছে স্থানীয় তৃণমূল শিবির। আবার একই কারণে আতঙ্কে ভুগছে গ্রামে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের পরিবারগুলি।

ওই গ্রামের তৃণমূল কর্মী তথা বিজেপি কর্মীদের উপর হামলা চালানোয় অন্যতম অভিযুক্ত সুদন গরাই এ দিন বলেন, “আমাদের উপরে বিজেপি কর্মীরা যে ভাবে হামলা চালাচ্ছিল, অরূপবাবু গ্রামে যাওয়ার পরে ওরা আর সে সাহস পাবে না বলেই মনে হচ্ছে। দল আমাদের পাশে রয়েছে বোঝা গেল।” অরূপবাবুর বরাভয়ের পরেও অবশ্য অনেক তৃণমূল কর্মীই গ্রামে ফেরার সাহস পাচ্ছেন না। সুদনবাবুর কথায়, “কিছু না করেই মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হলাম। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কী ভাবে গ্রামে ফিরব, তা নিয়ে অরূপবাবুর সঙ্গে কথা বলব।”

সুনসান মন্যাডি। বুধবার।

গ্রামের বিজেপি সমর্থিত পরিবারের এক বধূর আবার দাবি, “৫০ বছর এই গ্রামে বাস করছি। সিপিএমের লোকেরা রাতের অন্ধকারে বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে জিনিসপত্র লুঠপাট করত। কিন্তু, অস্ত্র নিয়ে কাউকে খুন করতে যেত না। তৃণমূল কর্মীরা সেটাই করছে। এরা সিপিএমের চেয়েও ভয়ঙ্কর!” অরূপবাবুর বক্তব্যের পরে গ্রামের বিজেপি সমর্থিত পরিবারের মহিলাদের ঘুম ছুটেছে জানিয়ে স্থানীয় বধূ আরতি গরাই, মুক্তা গরাইরা বলেন, “সভাধিপতি গ্রাম ঘুরে যাওয়ার পরে ওরা (তৃণমূল) আরও সাহস পেয়ে গিয়েছে। ভয়ে আমরা রাতে ঘুমতে পারছি না। আমাদের বাড়ির ছেলেরা ফিরে এলে ফের হয়তো ওদের মারধর করা হবে। খুনও হয়ে যেতে পারে।”

গ্রামে পুলিশ মোতায়েন থাকার পরেও কেন এত ভয়? উত্তরে ওই মহিলারা বলেন, “পুলিশ কমিউনিটি হলের বাইরে খুব একটা বের হচ্ছে না। রাতেও ওদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। গোলমাল বাধলে ওরা যখন জানতে পারবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।” উল্টো দিকে, মন্যাডির তৃণমূল সমর্থিত পরিবারের বধূ জোৎস্না গরাই, কল্পনা গরাইরা বলছেন, “আমাদের গ্রামে বিজেপি-র খুব বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। সভাধিপতির ধমকটা দরকার ছিল।”

যদিও ধমক দিয়ে বিজেপি-তে যোগদান করা আটকানো যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহ। এ দিন ওন্দা ও বিষ্ণুপুরের লোখ্যাশোলে তাঁর দু’টি জনসভায় কয়েক হাজার মানুষ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি-তে যোগ দেন। রাহুলবাবুর দাবি, “তৃণমূল ভয় দেখিয়ে হুমকি দিয়ে মানুষকে আটকাতে পারবে না। এ সব করে দলের ভাবমূর্তিই খারাপ করছেন নেতারা।” তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল ও অরূপ চক্রবর্তী, দু’জনের প্রসঙ্গ টেনে রাহুলবাবু জনসভায় বলেন, “নিজেদের বদলি আটকাতে আজ এই নেতাদের ‘সাত খুন মাফ’ করে তাঁদের মাথায় চড়াচ্ছেন পুলিশ কর্তারা। আজ এঁরা কু-মন্তব্য করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কাল কিন্তু এঁরাই পুলিশের পোশাক ধরে টানাটানি করবে! তখন আপনাদের সম্মান আর থাকবে?” এর পরেই পুলিশকর্মীদের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “মনে রাখবেন তৃণমূল আপনাদের বেতন দেয় না। সাধারণ মানুষের টাকাতেই আপনারা মাইনে পান। তাই অবিলম্বে ওই দুই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করুন।”

পরে ফোনে রাহুলবাবু জানান, অরূপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তৃণমূল কর্মীদের সাধারণ মানুষকে খুন করতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করবে বিজেপি। তিনি বলেন, “এক জন সভাধিপতি হয়ে প্রকাশ্যে মানুষকে খুন করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন অরূপবাবু। তৃণমূল কতটা নীচে নেমে গিয়েছে, ভাবলে অবাক লাগছে!” অরূপবাবুর ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে এ দিন গঙ্গাজলঘাটিতেও একটি পথসভা করেন বিজেপি ব্লক নেতৃত্ব। সেখানে দলের নেতা অজয় ঘটক দাবি করেন, “জেলায় রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সব ক্ষেত্রেই বিজেপি কর্মীদের নিশানা করছে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে সভাধিপতি সরাসরি দলীয় কর্মীদের খুন করার অনুমতি দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”

অরূপবাবু নিজে অবশ্য বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা তাঁর সমালোচনা বা গ্রেফতারের দাবিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ। এ দিন দলীয় বৈঠকে যোগ দিতে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। নিজের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়ার রাস্তায় তিনি হাঁটতে চাইছেন না। বরং ফোনে তিনি বলেন, “মন্যাডিতে আমাদের দলের সমর্থক পরিবারের মহিলাদের ঘরে ঢুকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে জেনেই আমি তাঁদের আত্মরক্ষার স্বার্থে দুষ্কৃতীদের উপরে পাল্টা হামলার পরামর্শ দিয়েছি। কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে এই মহিলা সমিতির সদস্যেরাই নানা প্রশ্ন তোলেন। অথচ এখন এঁরাই আমাকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন! আমি বুঝে উঠতে পারছি না, এরা মহিলা সমিতি না দুষ্কৃতী বাঁচাও সমিতি। না কি এঁরা বিজেপি-র সহযোগী।” এর পরেই তাঁর হুঁশিয়ারি, তিনি আইনজীবী হওয়ায় আইনের মারপ্যাঁচ ভালই বোঝেন। মিথ্যা এফআইআর করলে ১০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করবেন ওই মহিলা সংগঠনের বিরুদ্ধে।

অরূপবাবুর আরও দাবি, “আমি সভাধিপতি হওয়ার পরে বাঁকুড়ার এত উন্নয়ন করেছি যে, বিরোধীরা রাজনৈতিক বিরোধিতার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই আমার বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারে নেমেছে।” যদিও জেলা তৃণমূলে সভাধিপতির বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর একাধিক নেতা এ দিন বলছেন, দল কোনও নেতাকেই এ রকম উস্কানিমূলক মন্তব্য করার অধিকার দেয়নি। এক জন সভাধিপতির মুখে এই ধরনের কথা মানায় না। দলের রাজ্য নেতৃত্বের উচিত ওঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা।

ছবি: অভিজিৎ সিংহ ও শুভ্র মিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police fir rahul sinha manyadi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE