Advertisement
E-Paper

ফর্ম তোলার প্রথম দিনেই চরম দুর্ভোগ

হাসান আলি। বাড়ি মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার বিশ্বনাথপুরে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য রামপুরহাট কলেজে ফর্ম তুলতে চায়। আকাশের মুখ ভার থাকায় কীভাবে দু’ঘণ্টা দূরের রামপুরহাট পৌঁছবে, তা নিয়ে সকাল থেকেই অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। কোনও রকমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রামপুরহাটগামী বাসে চেপে বসল। বাসস্ট্যান্ড থেকে নামতেই হাসান দেখতে পেল তার মতোই বহু ছাত্রছাত্রী রামপুরহাট কলেজের দিকে হনহন করে ছুটছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৪ ০১:২৯
‘অফলাইন’। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তির ফর্ম তোলার জন্য লম্বা লাইন। ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘অফলাইন’। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তির ফর্ম তোলার জন্য লম্বা লাইন। ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

হাসান আলি। বাড়ি মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার বিশ্বনাথপুরে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য রামপুরহাট কলেজে ফর্ম তুলতে চায়। আকাশের মুখ ভার থাকায় কীভাবে দু’ঘণ্টা দূরের রামপুরহাট পৌঁছবে, তা নিয়ে সকাল থেকেই অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। কোনও রকমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রামপুরহাটগামী বাসে চেপে বসল। বাসস্ট্যান্ড থেকে নামতেই হাসান দেখতে পেল তার মতোই বহু ছাত্রছাত্রী রামপুরহাট কলেজের দিকে হনহন করে ছুটছে। সকাল ১১টা নাগাদ যখন সে কলেজের গেটের কাছে পৌঁছল, তার সামনে তখন প্রায় ৫০০ জন ছাত্রছাত্রীর লাইন। রোদে-গরমে কাহিল হয়ে তারও প্রায় দু’ঘণ্টা পরে কলেজের এক পরিচিত দাদাকে ‘ধরে’ কোনও রকমে ভর্তির ফর্ম হাসিল করল হাসান।

কলেজে ফর্ম তুলতে গিয়ে হাসান আলির এই অভিজ্ঞতা কোনও বিরল ঘটনা নয়। মঙ্গলবার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত জেলার বিভিন্ন কলেজে ভর্তির ফর্ম দেওয়া শুরু হতেই প্রায় একই অভিজ্ঞতার মুখে পড়লেন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকেরা। শুধু লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার হয়রানিই নয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলির দাদাগিরিও। এই পরিস্থিতিতে আবেদনকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠেরই মত, গোটা প্রক্রিয়া অনলাইনে চালু হলে এ রকম দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হত না। আবার বন্ধ হয়ে যেত ছাত্র সংগঠনগুলির দাদাগিরিও। অভিযোগ, গত বছরও কেন্দ্রীয় ভাবে ওই সব কলেজগুলিতে অনলাইন ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী কলেজগুলি ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করে নিয়েছিল। পড়ুয়াদের কোথাও কোনও ঝামেলা বা দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু পরিকাঠামো থাকলেও উচ্চশিক্ষা দফতরের মনোভাব দেখে অনেক কলেজই অনলাইন প্রক্রিয়া রদ করেছে। এ বছর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক দেবকুমার পাঁজার দাবি, “পরিকাঠামোগত কিছু সমস্যার জন্যই এ বছর অনলাইন ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে হয়েছে।”

এ দিন রামপুরহাট কলেজে গিয়ে দেখা গেল, কলেজ গেট থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে ফর্ম তুলতে আসা ছাত্রছাত্রীদের লাইন। লাইনেই দেখা মিলল রামপুরহাটের লক্ষ্মীমাটি গ্রামের অদৃষ্ট দাসের। একই স্কুল থেকে পাশ করে তিন বন্ধু মিলে রামপুরহাটে ফর্ম তুলতে এসেছে। দিনমজুর পরিবারের ছেলে অদৃষ্ট ভূগোল অনার্স নিয়ে পড়তে চায়। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ কলেজে এসে ফর্ম তোলার জনসমুদ্র দেখে একবার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিল। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে তারা ওই লাইনের শেষেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ফর্ম মিলল তারও দু’ঘণ্টা পরে। ফেরার পথে অদৃষ্ট বলল, “ফর্ম পেতেই হবে, এই জেদ ধরে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি। জল খেতেও যেতে পারিনি। এই গরমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলই ফর্ম পেত হল।” ভর্তিতে অনলাইনর ব্যবস্থা থাকলে এই পরিশ্রম করার প্রয়োজনই পড়ত না বলেই সে মনে করে।

অন্য দিকে, প্রাণিবিদ্যা নিয়ে অনার্স পড়তে চায় নিশ্চিন্তপুর এলাকার তরুণী ইন্দ্রাণী দাসে। ফর্ম তুলতে সকাল ১১টাতেই চলে এসেছে। দুপুর ১টার সময় লাইনে দাঁড়িয়ে মাথায় জল ঢালতে ঢালতে ইন্দ্রাণী বলল, “আগে না হয়, প্রযুক্তি ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কলেজে ভর্তিতে অনলাইন ব্যবস্থা চালু না করা বোকামির চূড়ান্ত। এ ভাবে ফর্ম তুলতে এসে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার দায় কে নেবে?” অনলাইনের সুবিধা থাকলে বাড়িতে বা ক্যাফে থেকে কোনও ঝামেলা, দাদাগিরি ছাড়াই ফর্ম তোলা যেত বলে তার দাবি। গোটা প্রক্রিয়া নিয়েই বিরক্তি প্রকাশ করলেন ময়ূরেশ্বরের লছিয়াতোড় থেকে ছেলের জন্য ফর্ম তুলতে আসা রেজাউল শেখ। তাঁর মতোই লোহাপুর থেকে ফর্ম তুলতে আসা দশ বন্ধুও অনলাইন ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করলেন।

নবাগত ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তির একই চিত্র ছিল অন্য মহকুমাগুলিতেও। মেয়ের জন্য ফর্ম তুলতে বিদ্যাসাগর কলেজে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সিউড়ি রবীন্দ্রপল্লির বাসিন্দা অরুণ চক্রবর্তী। লাইন একেবেঁকে জটিল হয়ে বহু দূর ছড়িয়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে অরুণবাবু বললেন, “একে এই গরম, তার উপর দীর্ঘ লাইন। ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনলাইনের মতো ব্যবস্থাও রাখা উচিত ছিল।” ছেলের জন্য ফর্ম তুলতে দিনমজুরি ছেড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সিউড়ির আর এক বাসিন্দা সনৎ দাস। তিনি বলেন, “কী আর করব, আমাদের কথা তো কেউ ভাবে না। তাই ফর্ম তুলতে এ ভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ফর্ম না তুলে ফিরব না।” বোলপুর কলেজেও সকাল থেকেই ফর্ম নেওয়ার দীর্ঘ লাইন। সেখানেও আমোদপুর থেকে ইলামবাজার, দূর-দূরান্ত থেকে অভিভাবক ও পড়ুয়ারা ফর্ম তুলতে ভিড় জমিয়ে ছিলেন। একই ভোগান্তির মধ্যে পড়তে দেখা যায় তাঁদেরও।

দুর্ভোগ কমাতে এ দিন কুড়ি মিনিট আগেই ফর্মের কাউন্টার খুলে দেওয়া হয় নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে। তাতেও অবশ্য সমস্যা খুব একটা মেটেনি। কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল হুদা বলেন, “সকাল সাড়ে দশটার সময় কলেজে ঢুকে দেখি গেটের সামনে প্রায় আড়াইশো জন লাইনে দাঁড়িয়ে। ফর্ম দেওয়ার কথা ছিল ১১টা থেকে। কিন্তু ওই লাইন দেখে কুড়ি মিনিট আগেই কাউন্টার খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিই।” তাঁর মত, “গত বার অনলাইন ব্যবস্থা থাকায় এ রকম চাপ ছিল না। তবে, এ বার পড়ুয়াদের সহযোগিতায় ফর্ম দেওয়া-নেওয়ার কাজ ভাল ভাবে করতে পারব বলেই মনে করছি।” তাঁর দাবি, কলেজের পরিকাঠামো না থাকায় এ বার অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। একই দাবি রামপুরহাট কলেজের অধ্যক্ষ জয়দেব পানেরও। তাঁর মন্তব্য, “উচ্চশিক্ষা দফতরের যা নির্দেশ, তা-ই মেনেই আমাদের তো চলতে হবে।”

ফর্ম তোলার সঙ্গে যুক্ত থাকা ছাত্র সংগঠনগুলির নেতাদের একাংশ মেনে নিচ্ছে, পড়ুয়াদের যতই ভোগান্তি হোক, ফর্ম তোলা-জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া আসলে নবাগত ছাত্রছাত্রীদের উপরে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রথম পাঠ। সেই সুযোগ তারা কোনও ভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। একই সঙ্গে পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ, তারই সুযোগে কিছু ক্ষেত্রে টাকাপয়সার বিনিময়ে বহু অযোগ্য আবেদনকারীকেই বেআইনি ভাবে আসন পাইয়ে দেওয়া হয়। অনলাইনে ভর্তির ব্যবস্থা থাকলে এই অস্বচ্ছতা দূর হয়ে যেত। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের এমন দুর্ভোগের মধ্যেও পড়তে হত না। কিন্তু, গত বছর পারলে, এ বছর কেন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা গেল না? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকের জবাব, “রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীই যেখানে কলেজে ভর্তিতে অনলাইন ব্যবস্থা চালুর পক্ষপাতী নন। তখন তাঁর বিরোধিতা করে, কার এত সাহস?”

online registration rampurhat college burdwan university
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy