Advertisement
E-Paper

বাগান ঘিরে উত্‌সাহ রাজনগরে

প্রথম জন যখন নিজের চাষযোগ্য জমিতে শ’তিনেক আম চারা লাগিয়ে ছিলেন, পড়শিরা কটাক্ষ করে বলেছিলেন এ ছেলের মাথাটা গিয়েছে। নইলে কেউ ধান চাষের জমিতে আমগাছ লাগায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫৩
প্রথাগত চাষের বাইরে ফলের বাগান করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মদন ঘোষ ও উত্তর মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

প্রথাগত চাষের বাইরে ফলের বাগান করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মদন ঘোষ ও উত্তর মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

প্রথম জন যখন নিজের চাষযোগ্য জমিতে শ’তিনেক আম চারা লাগিয়ে ছিলেন, পড়শিরা কটাক্ষ করে বলেছিলেন এ ছেলের মাথাটা গিয়েছে। নইলে কেউ ধান চাষের জমিতে আমগাছ লাগায়। দ্বিতীয় জন যখন ডাঙা জমিতে (যে জমিতে কৃষিকাজ সাধারণত হয় না বা আদর্শ নয়) ফলবাগান করার পরিকল্পনার কথা কৃষি আধিকারিকদের শুনিয়েছিলেন, তাতে আশ্বস্ত হতে পারেননি কৃষি আধিকারিকেরাও। প্রথম জন বর্তমানে তার আমবাগান থেকে বছরে ১০০ কুইন্টাল আম বিক্রি করতে পারেন। আর অন্য জন সেই ডাঙাজমিতেই প্রায় হাজার চারেক বিবিধ ফলের বাগান করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষি আধিকারিকদেরও। প্রথমজন উত্তম মণ্ডল। দ্বিতীয় জন মদন ঘোষ। দু’জনের বাড়ি রাজনগেরর গাংমুড়ি-জয়পুর পঞ্চায়েত এলাকায়।

প্রথাগত চাষের বাইরে লাভের মুখ দেখা সম্ভব এবং সেটা ধানের চাষের চেয়ে বহুগুন বেশি হতে পারে, ওই দুই চাষি ফল ও সব্জি বাগান করে সকলকে চমকে দিয়েছেন। জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ আধিকারিক সুবিমল মণ্ডল বলছেন, “ফল বা সব্জি বাগান করলে প্রথাগত চাষের থেকে বেশি লাভ পাওয়া যায়। জেলায় বাগান করার প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। তবে বাগানে উত্‌সাহ দেখাচ্ছেন রাজনগরের চাষিরাই বেশি। সকলেই যে তাতে সফল হচ্ছেন তা নয়। এ কারণ, প্রথম দু-তিন বছর নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত যখন জলের অভাব দেখা যায় ফলের চারা লাগানোর পর গাছগুলি বাঁচিয়ে রাখাই কষ্টকর। গাছে জল দেওয়া ও যত্নের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত গাছের গোড়ায় লাউ বা কুমড়ো জাতীয় ফসল লাগিয়ে পরিচর্যা করলে ফলের গাছগুলিও যত্ন হয়। মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে একটা আয়ও পাওয়া যায়। মদনবাবুরা সেটা করতে পেরেছেন। যা অন্য চাষিদের কাছেও দৃষ্টান্ত হতে পারে।”

কী ভাবে এগোলেন তাঁরা?

জাহানাবাদ গ্রামের উত্তম মণ্ডল বলছেন, “মাধ্যমিক পাশ করার পরই দেখলাম কৃষি শ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। মূলত চাষে শ্রমিক নির্ভরতা কমানোর ভাবনা থেকেই ধান জমিতে আমগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেম বছর পনেরো আগেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কৃষি দফতরের পরামর্শ নিয়েছিলাম। হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি ও মল্লিকা মোট চার প্রজাতির আমচারা যখন কৃষিজমিতে লাগালাম তখন সবাই হেসেছিল। বছর চারেক পর থেকে ফলন হতে শুরু করল। তখন থেকেই সব কষ্ট লাঘব হয়েছে। কয়েক বছর যথেষ্ট ভাল আম হচ্ছে। গত বার আম বিক্রি করে ৩ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম।” শুধু আম নয়। আমবাগানে সফল হওয়ার পর ডাঙা সাড়ে সাত বিঘা জমিতে টোম্যাটো চাষ করেও যথষ্ট সফল উত্তমবাবু। এ বারও টোম্যাটো চাষ করছেন তিনি। ফলনও উঠতে শুরু করেছে। তিনি জানান, বিক্রিও হচ্ছে দিনে গড়ে প্রায় ৮-১০ কুইন্টাল টোম্যাটো। চাষে খরচ হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। টোম্যাটো চাষ করতেও প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন? এর উত্তরে উত্তমবাবু বলেন, “ওই জমিতে আগে কোনও চাষ হত না। কিন্তু বর্ষাকালে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে থাকে তাতে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে মাটিতে যে পরিমাণ আর্দ্রতা থাকে তাতে সব্জি চাষ করার কথা মাথায় আসে। দ্বিতীয়ত চাষ শেষে কৃষি শ্রমিক পাওয়াও তুলনায় সহজ হয়। কারণ, তখন মানুষের হাতে তেমন কাজ থাকে না। সেই থেকেই টোম্যাটো চাষ শুরু করেছিলাম।”

কী বলছেন তালপুকুর গ্রামের মদন ঘোষ?

এমনিতেই ব্লকের যথেষ্ট নামকরা চাষি তিনি। রাজ্য সরকারের কৃষকরত্ন পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু শুরুটা সহজ হয়নি। বছর সাতেক আগে একসময় সর্ষে লাগানোর জন্য ১ কিলো কৃষিবীজ চাইতে গিয়েও পাননি ব্লক কৃষি আধিকারিক কাছ থেকে। তিনি বলেন, “ওখান থেকে বলা হয়েছিল বীজ নিয়ে কী করবেন। চাটনি করে খেয়ে ফেলবেন না তো।” যে কৃষি আধিকারিক ওই মন্তব্য করেছিলেন (সেই সময় রাজনগর ব্লকের দায়িত্বে ছিলেন) সেই বিপ্লব প্রতিহার বর্তমানে বর্ধমানের ভাতার ব্লকের দায়িত্বে আছেন। তিনিই পরে মদনবাবুর চাষে আগ্রহ দেখে সয়াবিন ও সূর্যমুখী চাষ। তারও পরে কাপাস তুলো চাষে উত্‌সাহ জুগিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যেকটি চাষে জেলার সেরা হওয়ায় জেদ আরও বেড়ে গিয়েছিল মদনবাবুর। শখ ছিল বড় জমি পেলে ফলের বাগান করার। সেই সুযোগও মিলে গিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। রাজনগরের জয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তপনকুমার রায়ের সহযোগিতায় অল্প টাকায় একটা বিশাল মাপের ডাঙা জমি কিনে তাতে ফল চাষ শুরু করেন। তপনবাবুর পরামর্শ দিলেও বাগান করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন মদনবাবু। তিনি বলেন, “শুধু আম গাছই রয়েছে ১২০০টি। এ ছাড়া লিচু, সফেদা, জামরুল, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকি, হরিতকি বহড়া এবং চেরি, ড্রাগন ফ্রুট জাতীয় বিদেশি ফলের গাছ মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ প্রজাতির ফল গাছ রয়েছে। রয়েছে তেজপাতা ও দারুচিনির মতো বিবিধ মশলার গাছও। প্রথম দু’বছর একটি ডোবা কেটে সেচ দিয়ে গাছ বাঁচিয়ে রেখেছি। এখন প্রায় সব গাছই বড় হয়ে এসেছে। আম-সহ কিছু গাছে ফলনও দিচ্ছে। তবে এখন গাছে সেটের জন্য দু’টি কুয়ো কাটানো হয়েছে জেলা উদ্যান পালন বিভাগ ও সয়েল কনজার্ভেশন বিভাগের সৌজন্যে।”

উত্তমবাবুর ক্ষেত্রেও একই ভাবে সেচ কুয়ো খনন করিয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতর। তবে ফলের বাগানের জন্য প্রয়োজনীয় জমির জোগান রাজনগর বা খয়রাশোলের মতো জায়গায় যেখানে জমি পাওয়া তুলনায় সহজ। মূলত বৃষ্টি নির্ভর হওয়ায় যেখানে চাষ খুব একটা ভাল হয় না। তাঁরা বাগান করতেই পারেন বলে মত কৃষি দফতরের।

rajnagar garden
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy