ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হাত থেকে বালির ইজারা দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েও বিলি করে উঠতে পারেনি সেচ দফতর। কাজ বন্ধ থাকায় সংশয়ে শ্রমিকরাও। পুরুলিয়ার কংসাবতী নদীর তীরে। নিজস্ব চিত্র
ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হাত থেকে বালির ঘাটের ইজারার বিষয়টি সেচ দফতরের আওতায় এসেছে এক মাস হল। কিন্তু, পুরুলিয়ার বিভিন্ন নদীর ঘাটগুলির ইজারার বিষয়টি এখনও সেচ দফতরের ফাইলবন্দি থাকায় সমস্যায় পড়েছেন ইজারাদারেরা। আর এই সমস্যার আড়ালে বিভিন্ন ঘাট থেকে অবাধে চলছে বালি লুঠ। যার কোনও রাজস্বই যাচ্ছে না সরকারের কোষাগারে। যদিও সেচ দফতরের বক্তব্য, বালি তোলার ইজারাদারদের ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি থমকে নেই।
জেলার বিভিন্ন ব্লকের নদীঘাটগুলি থেকে এত দিন বালি তোলার বিষয়টি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের নজরদারিতে স্থানীয় ইজারাদারেরাই দেখভাল করতেন। চলতি অগস্ট মাস থেকে ওই দায়িত্ব সেচ দফতরের আওতায় এসেছে। জেলার একাধিক ইজারাদারের ক্ষোভ, বিভিন্ন ব্লকের নদীঘাট থেকে বালি তোলার ইজারা পাওয়ার জন্য তাঁদের আবেদন মাসখানেকেরও বেশি ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকছে সেচ দফতরে। বারবার দফতরে যোগাযোগ করলেও বিভিন্ন অজুহাতে ঘোরানো হচ্ছে। পুরুলিয়া শহরের ইজারাদার সুদীপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “ইজারাদারেরা অনুমতি না পাওয়ায় সরকারেরও রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।” জয়দেব আঢ্য নামে অন্য এক ইজারাদার বলেন, “আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তো হচ্ছেই। যে সমস্ত শ্রমিক বৈধ ভাবে বালি তোলার কাজ করতেন, তাঁরাও এখন কাজ পাচ্ছেন না।” ইজারাদারদের দাবি, সেচ দফতর খোঁজ নিলে জানতে পারবে বালি তোলা কিন্তু আটকে নেই। বরং বিভিন্ন নদীঘাটে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাগোপ্তা ভাবে অবাধে বালি তোলা চলছে।
পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে কংসাবতী নদীর একটি ঘাটের ইজারাদার সামাদ আনসারি আবার অন্য সমস্যার কথা শোনালেন। তাঁকে সেচ দফতর ওই ঘাট থেকে বালি তোলার রয়্যালটি সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে। সমস্যা হচ্ছে নদীর অন্য ঘাটগুলির রয়্যালটি সংগ্রহের অনুমতি এখনও কেউ পায়নি। ফলে, একটা ঘাটেই প্রতিদিন বালি সংগ্রহের জন্য প্রচণ্ড ভিড় হচ্ছে। “এই ঘাটে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে সাতশো থেকে হাজার ট্রাক্টর বালির চাহিদা রয়েছে। অথচ সেচ দফতর আমাকে খুব বেশি হলে আড়াইশো থেকে সাড়ে তিনশো ট্রাক্টর বালি তোলার অনুমোদন দিচ্ছে। এর ফলে, এক দিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনই অনেক ট্রাক্টরও কাজ পাচ্ছে না। বসে থাকতে হচ্ছে শ্রমিকদেরও।”বলছেন সামাদ আনসারি।
এই ঘাটের এক ট্রাক্টরের মালিক, পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার বাসিন্দা মনোজ মাহাতো জানালেন, তিনি ঋণ নিয়ে ট্রাক্টর কিনেছেন। তাঁর মতো অনেকেরই ট্রাক্টরে বেশির ভাগ বালিই চলে। বালি নিয়ে যেতে পারলে কিছুটা লাভের মুখ দেখেন তাঁরা। মনোজের আক্ষেপ, “মাস দেড়েক কাজ নেই বললেই চলে। কেন না, বিভিন্ন ঘাট থেকে বালি তোলা বন্ধ রয়েছে। যদিও বা দু-একজন রয়্যালটি সংগ্রহের অনুমতি পেয়েছেন, সেখানে ট্রাক্টরের চাহিদা এত বেশি যে, প্রতিদিন ট্রিপ পাচ্ছি না।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইজারাদারের কথায়, “সেচ দফতরে বালি তোলার ইজারার অনুমোদন ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ রাতের অন্ধকারে কংসবাতীর অন্য ঘাটগুলি থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালি তোলা চলছেই।”
সেচ দফতর ইজারাদারদের অনুমতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখায় ট্রাক্টরগুলিও বসে রয়েছে বলে অভিযোগ ‘পুরুলিয়া ট্রাক্টর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর। ওই সংগঠনের সদস্য দীপক নাথ বলেন, “বালি তোলার অনুমতির বিষয়টি সেচ দফতরে আটকে থাকায় আমরা ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি। বিভিন্ন সদস্য কিস্তিতে ট্রাক্টর কিনেছেন। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই টাকা মেটানো সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।” বিভিন্ন ব্লক সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় কমবেশি হাজার দুয়েক ট্রাক্টর রয়েছে। যাদের একটা বড় অংশই বালি বহনের কাজ করে। দিন কয়েক আগে এই সংগঠনের পক্ষ থেকেও দ্রুত বালি তোলার ছাড়পত্রের দেওয়ার দাবিতে সেচ দফতরে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে।
সেচ দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ চক্রবর্তী অবশ্য জানিয়েছেন, ইজারাদারদের বালি তোলার ছাড়পত্র দেওয়ার কাজ থমকে নেই। ইজারার অনুমতি দেওয়ার কাজ চলছে। নির্ধারিত ফর্মে যাঁরা আবেদন করছেন, তাঁদের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কত আবেদন জমা পড়েছে এবং কত জনকে এখনও অবধি অনুমতি দেওয়া হয়েছে জানতে চাওয়ায় তিনি জানান, সেটা নথি দেখে বলতে হবে। জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বালি নিয়ে সর্বত্র না হলেও বেশ কিছু জায়গায় অচলাবস্থা হয়েছে। কিন্তু একটি দফতরের হাত থেকে অন্য একটি দফতরের হাতে বিষয়টি গিয়েছে। এই সমস্যা সাময়িক। আমরা দেখব রাজস্ব আদায় কী ভাবে বেশি হতে পারে।”
কিন্তু জেলার বিভিন্ন ঘাট থেকে বেশি বালি তুলে কাগজে-কলমে কম রয়্যালটি দেখানো হচ্ছে কি না, তার সঠিক নজরদারি কী ভাবে করা সম্ভব? সুজয়বাবু বলেন, “সেটা আমরা সেচ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করব।” বিদ্যুৎবাবু বলেন, “আমাদের দফতরের কাছে বিষয়টি নতুন হলেও আমরা এই দিকে অবশ্যই নজরদারি চালাব। কী ভাবে নজরদারি চালানো হবে, তা-ও আমাদের ভাবনায় রয়েছে।” জেলা সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোও রাজস্ব ক্ষতির সত্যতা মেনে নিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, “বালিঘাটের ইজারা দেওয়ার বিষয়টি সেচ দফতরের পক্ষে নতুন। তাই একটু সময় লাগছে। সেচ দফতর যখন গোটা ব্যাপারটা দেখভাল করবে, তখন রাজস্ব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy