Advertisement
০৬ মে ২০২৪
ছাতনা

ভাঙা ছাউনিতেই পাথর ঠুকছেন শিল্পীরা

শুশুনিয়ায় বেড়াতে এসে পাথরের ভাস্কর্য বাড়ি নিয়ে যাননি এমন পর্যটকের সংখ্যা হাতে গোনা। ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এখানকার পাথর শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, এমনকী দেশান্তরেও। শুশুনিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাওয়া এই পাথর শিল্পের সুদিন তবু ফেরেনি। এখনও শুশুনিয়া পাহাড়তলিতে ঝর্ণাতলার রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ঝুপড়ির মধ্যে পাথর শিল্পের পসরা নিয়ে শিল্পীরা ক্রেতার অপেক্ষায় বছরভর বসে থাকেন। বাঁশ-ডালের খুঁটিতে লাল, নীল, কালো ত্রিপলের সারি সারি ছাউনি।

শুশুনিয়ার পাথর শিল্পীদের সুদিন ফেরেনি। জল-বৃষ্টির মধ্যেই নড়বড়ে অস্থায়ী ছাউনির নীচেই চলে বেচাকেনা। ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

শুশুনিয়ার পাথর শিল্পীদের সুদিন ফেরেনি। জল-বৃষ্টির মধ্যেই নড়বড়ে অস্থায়ী ছাউনির নীচেই চলে বেচাকেনা। ছবিটি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০০:২৪
Share: Save:

শুশুনিয়ায় বেড়াতে এসে পাথরের ভাস্কর্য বাড়ি নিয়ে যাননি এমন পর্যটকের সংখ্যা হাতে গোনা। ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এখানকার পাথর শিল্প ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, এমনকী দেশান্তরেও।

শুশুনিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাওয়া এই পাথর শিল্পের সুদিন তবু ফেরেনি।

এখনও শুশুনিয়া পাহাড়তলিতে ঝর্ণাতলার রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ঝুপড়ির মধ্যে পাথর শিল্পের পসরা নিয়ে শিল্পীরা ক্রেতার অপেক্ষায় বছরভর বসে থাকেন। বাঁশ-ডালের খুঁটিতে লাল, নীল, কালো ত্রিপলের সারি সারি ছাউনি। তার নীচে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত বছরভর বসে থাকেন শিল্পীরা। মূলত শীতেই পর্যটকদের ভিড় থাকে এই চত্বরে। বছরের বাকি সময়ে পর্যটকের আনাগোনা কমে যায়। তার গরমের সময় তো লু-র দাপটে খোলা জায়গায় থাকাই দায়। কাজেই সে সময়ে পর্যটকদের দেখাই কার্যত পাওয়া যায় না। কিন্তু ওই অস্থায়ী ছাউনির নীচে বসেই শিল্পীরা পাথরে ছেনি-হাতুড়ি ঠুক ঠুক শব্দে ঠুকে শিল্পকর্ম তৈরি করে যান। আর অপেক্ষা করেন, কখন ক্রেতারা আসবেন। দু’টো বিক্রিবাটা হবে। ঘরে কষ্টের রোজগার নিয়ে যাবেন। তাঁদের আক্ষেপ, প্রশাসন শুশুনিয়ার পর্যটনের বিকাশে নজর দিয়েছে। কিন্তু আমাদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। এ ভাবেই আমাদের দিন কাটবে?

এখানকার শিল্পীদের আরও একটি সমস্যা ভাবাচ্ছে, তা হল কাঁচামাল। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, শুশুনিয়ার যে পাথর দিয়ে তাঁরা নানা জিনিসপত্র গড়েন, তার গুণগত মান খুব একটা ভালো নয়। পাথরে বালির ভাগ বেশি। শুধু তাই নয়, শুশুনিয়া থেকে পাথর নিতে গেলে বন দফতরের বাধাও রয়েছে। ফলে বড় পাথর খুব একটা পাওয়াও যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ওড়িশা বা রাজস্থানের জয়পুর থেকে পাথর আমদানি করতে হয় শিল্পীদের। সে ক্ষেত্রে মাধ্যম কলকাতার ব্যবসায়ীরা। কিন্তু হাত ঘুরে পাথর কেনার জন্য গাঁটের কড়ি বেশি খসাতে হচ্ছে। শিল্পীদের দাবি, বেশি দাম দিয়ে পাথর কেনার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাঁদের অনেকেরই নেই। তাই অনেকেই পাথরের কাজ কমিয়ে দিয়েছেন।

শুশুনিয়ার পাথর শিল্পী অরবিন্দ কর্মকার, মোহনচন্দ্র দাস বলেন, “পাথরের জোগান এখানে কম। মানও ভাল নয়। পাথর নিতে গেলে বন দফতরের চোখ রাঙানির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। রাজ্য সরকার যদি কম দামে আমাদের পাথর দেওয়ার কিছু ব্যবস্থা করে, তাহলে ভাল হয়।” আর এক পাথর শিল্পী তারকনাথ রায় জানান, পসরা নিয়ে বসার জায়গারও সমস্যা রয়েছে এখানে। শুশুনিয়ার পাহাড়ের তলায় তাঁদের বসার জন্য স্থায়ী কাঠামোর দাবি দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি তা গড়ে দেওয়া হবে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু সেই কাজ এখনও শুরু হয়নি। তাঁর দাবি। দ্রুত কাজ শুরু হোক।

ছাতনা কেন্দ্রের বিধায়ক শুভাশিস বটব্যালের আশ্বাস, “পাথর শিল্পীদের জন্য শুশুনিয়াতেই ‘কমন ফেসিলিটি অ্যান্ড প্রোডাকশন সেন্টার’ গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। ওই সেন্টার তৈরির জন্য টাকা বরাদ্দ হয়ে গিয়েছে। জায়গাও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। টেন্ডার ডাকার প্রক্রিয়া চলছে। ওই কেন্দ্র গড়ে উঠলে বেচাকেনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট জায়গা পাবেন শিল্পীরা।”

জেলা ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প দফতরের জেনারেল ম্যানেজার প্রণব নস্কর অবশ্য শুশুনিয়ার শিল্পীদের শিল্পকর্ম আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ার সরকারি প্রচেষ্টা জারি রয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “শুশুনিয়ার প্রায় ২০০ জন মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে এই পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সরকারি খরচে তাঁদের বিভিন্ন মেলায় পাঠানো হচ্ছে। জেলা শহর বাঁকুড়াতেও ‘গ্রামীণ হাট’ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে বসে শিল্পীরা সারা বছর তাঁদের জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারবেন।”

বস্তুত রাজ্যে সরকারের পালা বদলের পর ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পকে চাঙ্গা করতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে এই সরকার। সেই উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেন এখানকার শিল্পীরাও। বর্তমান রাজ্য সরকারকে অনেক সময় ‘মেলার সরকার’ বলে কটাক্ষ করে বিরোধীরা। যদিও মেলা বাড়ায় বেচাকেনার বাজারটাও অনেকটাই বেড়েছে বলে মেনে নিয়েছেন এখানকার শিল্পীরা। শিল্পীরা হাতে পেয়েছেন ‘আর্টিজেন কার্ড’ বা হস্তশিল্পীর পরিচিতিপত্র। সেই কার্ড দেখিয়ে প্রায়ই দিল্লি, কলকাতার পাশাপাশি আশপাশের জেলার মেলাগুলিতে শিল্পের পসরা নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কার্ডের দৌলতে কিছু ক্ষেত্রে সুবিধাও পাচ্ছেন। পরিচিতির পরিধিটা বাড়ছে। তাতে আখেরে শিল্পীদের ব্যবসা বাড়ছে।

তবে সে সুযোগ তো সবাই পাচ্ছেন না। অনেক শিল্পীদের বক্তব্য, “অল্প কয়েকজনকে সরকারি ভাবে ওই মেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই সুযোগ পেলে তবেই না এলাকার শিল্পীদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে।” জেলা শিল্প কেন্দ্রের ব্যাখ্যা, সারা জেলার বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে যেতে হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি শিল্পী নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব শিল্পীই যাতে সুযোগ পায়, সেই চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুজোর পরে মেলা বেশি হয়। তখন আবার শুশুনিয়া বহু শিল্পী পাহাড়তলির বাজার ছেড়ে নড়তে চান না। ছাতনার বাসিন্দা জেলা বিজেপি নেতা জীবন চক্রবর্তীর ক্ষোভ, “শুশুনিয়ার শিল্পীরা বরাবরই বঞ্চিত। তৃণমূল সরকার মুখে হস্ত ও কুটির শিল্পীদের নিয়ে অনেক প্রকল্পের বুলি আওয়ায়। কিন্তু শুশুনিয়ার শিল্পীদের হতশ্রী অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, তাঁরা সেই আঁধারেই রয়েছেন। উন্নয়নের ছিঁটে ফোঁটাও সেখানে পৌঁছায়নি।”

শুশুনিয়ার পাথর শিল্পীদের এই সমস্যাগুলি রাজ্য সরকারের কাছে তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা পরিষদের বিদ্যুৎ ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্প দফতরের কর্মাধ্যক্ষ সুখেন বিদ। একই সঙ্গে তিনি ছাতনা ব্লকে বাঁশ ও কাঠ শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তাঁর মতে, “ছাতনা ব্লক জুড়ে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের প্রসার ঘটানো যেতে পারে। আমরা শিল্পীদের এই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পাথর শিল্পীদের সমস্যার কথাগুলি রাজ্যকে জানাব। বাইরের মেলায় যাতে আরও বেশি সংখ্যায় পাথর শিল্পী যাওয়ার সুযোগ পান সেই দিকটিও দেখছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor chatna rajdeep bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE