হারিয়েছে স্রোত। গন্ধেশ্বরী নদীর জমা জলে পড়ছে আবর্জনা। নর্দমার জল নদীতে ফেলার অভিযোগও রয়েছে।
আশঙ্কাই সত্যি হল। বাঁকুড়া পুরসভার পাঠানো গন্ধেশ্বরী পাম্প হাউসের জলের নমুনায় কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরা পড়েছে। ওই রিপোর্ট পেয়েই জল পরিশোধনের ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন পুর কর্তৃপক্ষ।
এই পাম্পহাউসটি পুরসভার সব থেকে প্রাচীন। গন্ধেশ্বরী নদী গর্ভ থেকে পাম্পের মাধ্যমে জল তুলে তা সরাসরি বাঁকুড়া শহরের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। নদীটির বিভিন্ন অংশে জল জমে গিয়ে শ্যাওলায় ভরে গিয়েছে। তার উপরে নদীর কিছু এলাকায় নর্দমার নোংরার জল ফেলা হয়ে বলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল। সম্প্রতি বিজেপি-ও সেই একই অভিযোগ তোলে। গন্ধেশ্বরী নদীর দূষিত জল বাঁকুড়া শহরে আর সরবরাহ করা চলবে না বলে দাবি তুলে শহরের একাধিক জায়গায় পথসভা করে বিজেপির নেতা-কর্মীরা।
ওই জল আদৌ দূষিত কি না তা সরেজমিনে জানতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ‘রুর্যাল ওয়াটার সাপ্লাই’ বিভাগের বাঁকুড়া মহকুমা দফতরে জলের নমুনা পাঠান বাঁকুড়ার পুরপ্রধান শম্পা দরিপা। পরীক্ষা করে সম্প্রতি তারা রিপোর্ট পাঠিয়েছে। তাতে ওই জলকে একেবারেই দূষণমুক্ত বলতে নারাজ বিশেষজ্ঞেরা। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ‘রুর্যাল ওয়াটার সাপ্লাই’ বিভাগ থেকে জানা গিয়েছে, গন্ধেশ্বরীর জলে ১০০ মিলিলিটার জলে টোটাল কলিফর্মের (টিসি) মাত্রা যেখানে ১০ এককের মধ্যে থাকার কথা, সেখানে রয়েছে ১৩ একক। ফিকাল কলিফর্মের (এফসি) মাত্রা ওই পরিমাণ জলে থাকার কথা ০, রয়েছে ৩ একক। ওই জলকে দূষণ মুক্ত করতে পুরসভাকে ভালো করে পরিস্রুত করার পরামর্শ দিয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এই বিভাগ।
পুরসভা সূত্রে জানা যাচ্ছে, শহরের চারটি ওয়ার্ডের বেশ কিছুটা অংশে গন্ধেশ্বরীর জল সরবরাহ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের পুরনো চণ্ডীমেলা, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজরাগলি, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাগদিপাড়া, দোলতলার মতো বেশ কিছু এলাকা। রয়েছে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠকপাড়ার একাংশ, মিশ্রপাড়া, পুরাতন রথতলার কিছুটা এলাকা। কয়েক হাজার মানুষ এই জলের উপরে নির্ভরশীল। অনেকে জল ফিল্টার করে পান করেন।
জেলায় পানীয় জলের গুণমান দেখাশোনা করার দায়িত্বে রয়েছেন জেলার ডেপুটি সিএমওএইচ-২ নিলয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “জলে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেশি থাকলে পেটে নানা ছোট খাটো সমস্যা তো হবেই, তেমন হলে ডায়েরিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-এ প্রভৃতি রোগ পর্যন্ত ছড়াতে পারে।” তবে গন্ধেশ্বরী নদীর জলের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কথা শোনার পরে তিনি জানান, ওই রিপোর্ট না দেখে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
তবে ওই রিপোর্ট পাওয়ার পরেই অবশ্য নড়েচড়ে বসেছেন পুরকর্তৃপক্ষ। জল তোলার পাম্প পাল্টানো ছাড়াও জল শোধনের ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। পুরপ্রধানের বক্তব্য, “আমরা জলের নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাকটেরিয়া ও কেমিক্যাল টেস্টের জন্য পাঠিয়েছিলাম। কেমিক্যালে কোনও সমস্যা না থাকলেও ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ একটু বেশি রয়েছে। তবে তা খুব একটা মারাত্মক নয়।” তিনি জানান, জল তোলার মেশিনের যন্ত্র পরিবর্তন করা ও জল পরিস্রুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।
এই নদীর গর্ভ থেকে তোলা জলই পান করেন বাসিন্দারা। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
ঘটনা হল বাঁকুড়া শহরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা এই গন্ধেশ্বরী নদী প্রশাসনিক উদাসীনতায় এখন মৃতপ্রায়। এই নদীর দু’টি জায়গা থেকে জল তুলে শহরে সেই জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। অথচ নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলা, শহরের পরিত্যক্ত নোংরা জল ফেলা বন্ধের ব্যাপারে পুরসভা উদাসীন বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ। নদীর চরে বিরাট রাজনৈতিক সভা সমাবেশও হয়েছে। এতে দূষণের মাত্রা আরও বেড়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে বারবার সরব হয়েছে গন্ধেশ্বরী নদী বাঁচাও কমিটি। পুরপ্রধানের অবশ্য দাবি, “শহরের নোংরা জল আর গন্ধেশ্বরীতে ফেলা হয় না। অন্য ভাবে সেই জল শহরের বাইরে বের করে দেওয়া হচ্ছে।” যদিও এই দাবি মানতে নারাজ গন্ধেশ্বরী নদী বাঁচাও কমিটির সম্পাদক গঙ্গা গোস্বামী। তিনি বলেন, “আজও শহরের নোংরা জল ও আবর্জনা আজও গন্ধেশ্বরীতে ফেলা হচ্ছে। একাধিক জায়গা দিয়ে নালাপথে নোংরা জল নদীতে এসে পড়ছে। নদীটিকে বাঁচাতে কেউ পদক্ষেপ করেনি। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
যাদের সাম্প্রতিক অভিযোগের পরে জল পরীক্ষা করানো হয়, সেই বিজেপি-র অন্যতম জেলা সাধারণ সম্পাদক নীলাদ্রি শেখর দানা বলেন, “আমরা অভিযোগ করেছিলাম বলেই পুরসভা জল পরীক্ষা করালো। না হলে জল দূষণের অভিযোগ পুরসভা মানত না। মানুষকেও পুরসভা দূষিত জলই পান করাত। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুরবাসীর স্বাস্থ্য নিয়ে আদৌ সচেতন নয় তৃণমূলের এই পুরপ্রশাসন।” তাঁর দাবি, শুধু কিছু যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করলেই হবে না, নিয়মিত জল পরীক্ষা করাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy