Advertisement
E-Paper

রাস্তা সংস্কার না করে অন্য খাতে ঢালতে চায় পুরসভা

বেহাল রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দের কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। অথচ পুরসভা রাস্তা না সারিয়ে অন্য খাতে ওই টাকা ব্যবহার করতে চায়। সিউড়ি পুরসভার এই সিদ্ধান্তের জেরে ঘোর বর্ষায় খানাখন্দে ভরা জেলা সদরের রাস্তাগুলির কঙ্কালসার চেহারা আরও প্রকট হয়েছে।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৪ ০১:০৭
পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড।

পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড।

বেহাল রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দের কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। অথচ পুরসভা রাস্তা না সারিয়ে অন্য খাতে ওই টাকা ব্যবহার করতে চায়। সিউড়ি পুরসভার এই সিদ্ধান্তের জেরে ঘোর বর্ষায় খানাখন্দে ভরা জেলা সদরের রাস্তাগুলির কঙ্কালসার চেহারা আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু রাস্তা নিয়ে শহরবাসীর এই দুর্ভোগের দিন কবে কাটবে, তা নিয়ে দিশা দেখাতে পারছে না বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত সিউড়ি পুরবোর্ড। টাকা অন্য খাতে খরচ করতে চেয়ে খোদ পুরপ্রধান জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। তিনি অবশ্য এখনও তা মঞ্জুর করেননি।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলছেন, “পুরপ্রধান এ ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু ওই টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করা আমার এক্তিয়ারভুক্ত নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরকে (রাজ্য মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স) জানিয়েছি। তারা যে নির্দেশ দেবে, তা-ই পালন করব।”

ঘটনা হল, বর্ষা এলেই সিউড়ির বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাস্তায় চলাফেরা করা দায় হয়ে পড়ে। এ বারও রাস্তার বিভিন্ন অংশে গর্ত হয়ে জল-কাদা জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। কোথাও যদি-বা রাস্তা ভাল, কিন্তু নিকাশির হাল এতটাই খারাপ যে একটু বৃষ্টি হলেই গোটা রাস্তা ডোবার চেহারা নিচ্ছে। সেই জল ভেঙেই পুরবাসীকে যাতায়াত করতে হচ্ছে। সিউড়ি শহরের দীর্ঘ দিনের এই দৈন্য দশার চিত্রটা এ বার অনেকটাই বদলে যেতে পারত। কিন্তু অভিযোগ, পুরবোর্ডের গাফিলতিতে এই বর্ষাতেও ঘুচলো না মানুষের দুর্ভোগ। কারণ, রাজ্যের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স’ সিউড়ি শহরের ১৪টি ভাঙাচোরা রাস্তা ও নিকাশি নালা সংস্কার এবং তা নতুন করে নির্মাণের জন্য ৩ কোটি ৪৬ লক্ষ ১৬ হাজার টাকার অনুমোদন দিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই জেলা ট্রেজারির মিউনিসিপ্যাল ফান্ডে পুরো টাকাটা এসেও গিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ মাস কেটে গেলেও ওই কাজে হাত দেওয়া দূরঅস্ত, দরপত্রই ডাকা হয়নি। উল্টে ওই টাকা কীভাবে অন্য খাতে খরচ করা যায়, তার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে পুরসভা! তা নিয়ে পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় জেলাশাসকের কাছে বহুবার দরবারও করে ফেলেছেন।

পথের যন্ত্রণা। সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

প্রশাসন সূত্রের খবর, নিয়ম অনুযায়ী কোনও পুরসভা বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা এবং সেই কাজ সম্পন্ন করতে কত টাকা খরচ পড়ে, এ বিষয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট দফতরে একটি খসড়া জমা দেয়। তা খতিয়ে দেখে ‘মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স’ ওই নির্দিষ্ট কাজের জন্য টাকা বরাদ্দ করে। সেই টাকা ট্রেজারির মিউনিসিপ্যাল ফান্ডে এসে যাওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট কাজ করার জন্য পুরসভা দরপত্র ডাকে। কাজ সমাপ্ত হলে ট্রেজারির অনুমোদন সাপেক্ষে পুরসভা ঠিকাদারের নামে চেক ইস্যু করবে। ঠিকাদারের অ্যাকাউন্টে সেই টাকা স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। অন্য কোনও ভাবে বা অন্য কোনও খাতে বরাদ্দ টাকা সংশ্লিষ্ট পুরসভা খরচ করতে পারবে না। তবে, কাজের মধ্যে কোনও মাটি কাটার কাজ থাকলে (পুকুর বা নিকাশি নালা তৈরির জন্য) ট্রেজারি পুরসভার হিসাব রক্ষকের অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা অগ্রিম দিতে পারেন। এতে শ্রমিকদের টাকা পেতে সমস্যা হয় না। এর অন্যথা কোনও ভাবেই হওয়ার কথা নয়।

এখানেই প্রশ্ন উঠছে, পুরসভার এই সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা নিয়ে। পাশাপাশি বেহাল রাস্তা নিয়ে জেরবার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশেরই প্রশ্ন, রাস্তা সংস্কারের মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করতে চাওয়া, নৈতিক ভাবেও কি ঠিক? তা হলে এক খাতে আসা টাকা পুরসভার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করে অন্য খাতে খরচ করার উদ্দেশ্যে কেন বারবার জেলাশাসকের কাছে আবেদন করছেন পুরপ্রধান! সিউড়ির একমাত্র কংগ্রেস কাউন্সিলর ইয়াসিন আখতার বলছেন, “বর্ষায় এই শহরের রাস্তা ও নিকাশির সমস্যায় বাসিন্দাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। অথচ তৃণমূল পুরবোর্ড কোনও রেজোলিউশন ছাড়াই অন্য কাউন্সিলরদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বরাদ্দ টাকা খরচ না করে অন্য প্রকল্পে তা ব্যয় করার জন্য বারবার জেলাশাসকের কাছে আবেদন জানানোটাই বেআইনি।” আবার সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া, কাউন্সিলর দীপক দাসের (বাবন) হুঁশিয়ারি, যে যে রাস্তা এবং নিকাশি নালার জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, সেই কাজ করার জন্যই টাকা খরচ করতে হবে। এক খাতের টাকা অন্য খাতে খরচ করা হলে তাঁরা পুরবোর্ডের অনিয়মের বিরুদ্ধে পথে নামবেন।

কেন তা হলে উল্টে পথে হাঁটা?

পুরসভা সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে সিউড়ি পুরসভা চূড়ান্ত অর্থ সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। বিপুল অঙ্কের বিদ্যুতের বিল বাকি, জঞ্জাল পরিষ্কার করার ঠিকাদারেরাও নিয়মিত টাকা পাচ্ছেন না। সব চেয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে শহরে একলাখি বাড়ি প্রকল্পের টাকা নিয়ে। যে পরিমাণ টাকা জোগাড় করতে পারলে এবং ইউটিলাজেশন সার্টিফিকেট দিতে পারলে পরের ধাপে আরও বড় অঙ্কের বরাদ্দের অনুমোদন পুরসভা পেতে পারে, সেখানেই বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন বোর্ড ভেবেছিল, উন্নয়ন খাতে ‘মিউনিসিপ্যাল অ্যাফেয়ার্স’ থেকে বরাদ্দ টাকা অল্প সময়ের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অবস্থার সামাল দেবে। এ কথা মেনে নিয়েছেন খোদ পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ই। তাঁর যুক্তি, “একলাখি বাড়ি প্রকল্পের ইউসি দিতে ২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাস্তার জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে কিছুটা নিয়ে ওই খাতে দিতে পারলে পরের বরাদ্দে ৭ কোটি টাকা পেতে পারি। তখন তা দিয়ে রাস্তা, নিকাশি নালার কাজগুলোই করতে চাই।”

বাড়ি প্রকল্পের জন্য আসা টাকায় কেন টান পড়ল, পুরসভার এমন দৈন্য দশাই বা কেন, তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড অবশ্য তার সদুত্তর দিতে পারেনি। যদিও পুরসভা সূত্রেরই খবর, বর্তমান পুরবোর্ডের সমস্যার জায়গাটা গভীর। এই পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই একাধিক বার এক কাজে বরাদ্দ টাকা অন্য খাতে খরচ করার অভিযোগ উঠেছে। তা নিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। আর এই অভিযোগের মধ্যেই আসল গল্প লুকিয়ে রয়েছে বলে বিরোধী কাউন্সিলরদের দাবি। দীপক দাস এবং ইয়াসিন আখতাররা বলছেন, “এই যে বিভিন্ন প্রকল্পে টাকার টান পড়ছে, তার মূল কারণটাই হল পরিকল্পনা বহির্ভূত ভাবে এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা। তা ছাড়া বহু প্রকল্পের টাকা নয়ছয় তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে নিজের চালেই তৃণমূলের এই পুরবোর্ড আর্থিক সঙ্কটে কাৎ হয়েছে। আর সেই কারণেই ঠেলায় পড়ে ফের একটি নির্দিষ্ট খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করে আমাদের পুরপ্রধান উতরোতে চাইছেন।”

এই ভরা বর্ষার পরেও সিউড়ির মানুষের রাস্তা-দুর্ভোগ কাটবে কি না, তার উত্তর অবশ্য কারও কাছেই নেই।

road repair dayal sengupta suri other sectors
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy