Advertisement
০২ মে ২০২৪
খাদানে খাটছে পড়ুয়ারা

স্কুলছুট বাড়ছে পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চলে

এলাকায় নেই একটিও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। তার উপর যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন মজবুত নয়। তাই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে না হতেই স্কুল যাওয়ার পাটও শেষ! স্কুলের বদলে যাদের অধিকাংশকেই বেছে নিতে হয় পাথর খাদান বা ক্রাশারের ঘাম ঝরানো কঠিন জীবন।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪৬
Share: Save:

এলাকায় নেই একটিও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। তার উপর যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন মজবুত নয়। তাই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে না হতেই স্কুল যাওয়ার পাটও শেষ! স্কুলের বদলে যাদের অধিকাংশকেই বেছে নিতে হয় পাথর খাদান বা ক্রাশারের ঘাম ঝরানো কঠিন জীবন।

এমন দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে মহম্মদবাজারের পাথর শিল্পাঞ্চল পাঁচামি এলাকায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, যত দিন যাচ্ছে এ ভাবে উত্তরোত্তর স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে যার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন স্থানীয় স্কুলগুলির শিক্ষকদের একটা বড় অংশই। স্থানীয় গিড়িজোড় সাঁওতালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবকুমার সিংহের যেমন দাবি, “প্রয়োজন থাকলেও কাছাকাছি কোনও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল নেই। দূরত্বের কারণেই অধিকাংশ পড়ুয়ার আর মাধ্যমিকের পর পরা হয় না। গোটা পাঁচামিরই এই অবস্থা।”

মহম্মদবাজারের পাঁচামি, জেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পাঞ্চল। শুধু জেলা বা রাজ্য নয় অন্যান্য রাজ্যেও পাঁচামি এলাকার পাথরের যথেষ্ট সুনাম আছে। এই অঞ্চল থেকেই রাজস্ব বাবদ কোটি কোটি টাকা কর আদায় হয় রাজ্য সরকারের। অথচ উন্নয়ন? বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে আর এলাকায় ঘুরলেই মালুম হয়, এখানেই নেই রাজ্যের তালিকাই দীর্ঘ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট কোনও কিছুই এই শিল্পাঞ্চলের উন্নয়ন তেমন নজরে পড়ে না। এলাকার ক্ষোভ সেখানেই। মাধ্যমিকের পর যে অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের পক্ষে যে আর স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না, এ কথা দাবি করে বাসিন্দাদের বক্তব্য, কাছাকাছি একটা উচ্চমাধ্যমিক স্কুল কিংবা নিদেনপক্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ঠিক থাকলে ছেলেমেয়েদের এ ভাবে মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত না।

স্থানীয় সূত্রে খবর, ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের গিরিজোড় গ্রামে গিরিজোড় সাঁওতালি উচ্চবিদ্যালয় নামে একটি হাইস্কুল রয়েছে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার ওই স্কুলটি আগে জুনিয়র স্কুল ছিল। ১৯৭৮ সালে স্কুলটি মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়। ওই স্কুলের উপরই এলাকার গিরিজোড়, ঢোলকাটা, বেড়েপাড়া, জ্যেঠিয়া, শালডাঙা, বুড়িতলা, হরিনসিঙা, ইছেডাঙা, সেনবাঁদা, সাগরবাঁধি, পাথরপাড়া-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নির্ভর করে। প্রতিটি গ্রামই গিরিজোড় স্কুল থেকে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ওই সব গ্রাম থেকে স্কুলে আসার পথও সুগম নয়। এলাকায় কাছাকাছি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল বলতে কাপাসডাঙা ও দেউচায় স্কুল রয়েছে। স্থানীয় গ্রামগুলি থেকে দু’টি স্কুলেরই দূরত্ব কম করে ১০-১৫ কিলোমিটার। রাস্তাও বেশ খারাপ। ওই সব প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবে বহু যোজন পিছিয়ে থাকা ওই সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তাই ষষ্ঠ-সপ্তম, বড়জোর অষ্টম শ্রেণির পরে আর স্কুলমুখো হওয়া সম্ভব হয় না। পড়াশোনার পক্ষে বিরূপ পরিবেশ, অভাব ও নানা প্রতিকূলতার কারণে মা-বাবা, দাদা-দিদিদের হাত ধরে পাথর খাদান বা ক্রাশারে গিয়ে কাজ নেয় ওই সব স্কুলছুটেরা। তথ্য বলছে, এরই মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছে, যারা আবার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখে পড়াশোনাটা কোনও রকমে চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করে তারাও বেশির ভাগই পাথর শিল্পাঞ্চলের দৈনিক মজুরে পরিণত হয়। মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েও যে কারণে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে শালডাঙার অনিতা মুর্মু, মেরিলা সোরেন, ঢোলকাটার ধন মুর্মু, হাবড়াপাহাড়ির বেণী টুডুদের।

এ বছরই মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে বুড়িতলা গ্রামের সোনালি টুডু, পুরাতন হাবড়াপাহাড়ির কমল টুডুরা। তারা বলে, “কী করে আর পড়ব? মাধ্যমিক পাশ করে ভেবেছিলাম, আমাদের স্কুলটা উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে যাবে। পড়াশোনা চালিয়ে যাব। কিন্তু সে আর হল কই! তাই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।” কিন্তু কাপাসডাঙা ও দেউচায় তো উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে, সেখানে ভর্তি হতে কী সমস্যা? তাদের উত্তর, “ওই স্কুল দু’টি আমাদের এলাকা থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে। কোনও যানবাহন নেই। হয় পায়ে হেঁটে, না হয় সাইকেলে করে যাতায়াত করতে হয়। সেটা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে। সেই জন্যই এলাকায় মাধ্যমিকের পরে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।”

গিরিজোর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবকুমার সিংহ বলেন, “স্কুলের ৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। এমনিতে যত ছেলেমেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, তাদের অনেকেই সিক্স-সেভেনে স্কুল ছেড়ে দেয়। বিশেষ করে যাদের দূরে বাড়ি।” তাঁর হিসেব অনুযায়ী, গড়ে প্রতি বছর ৪৫-৫০ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। ২৫-৩০ জন পাশ করে। শুধু দূরত্ব ও যোগাযোগের কারণেই কাছাকাছি স্কুল না থাকায় এদের অধিকাংশই পড়া ছেড়ে দেয়। দেবকুমারবাবুর ব্যাখ্যা, আর্থিক কারণ থাকলেও এলাকায় একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের দাবি দীর্ঘ দিনের। সেটা হলেই এলাকায় ‘ড্রপআউট’দের সংক্ষ্যা কমে যাবে।

একই বক্তব্য এলাকার হরিনসিঙা ও মুরগাবনি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নলিন টুডু ও গোবিন্দ টুডু, রাজনগর বালিকা বিদ্যালয়ের তপতী সোরেন, সিউড়ি আরটি গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা খ্রিস্টিনা মাড্ডি, সিউড়ির বিদ্যাপীঠ শিক্ষক ফুলেশ্বর হাঁসদা ও বেণীমাধব স্কুলের শিক্ষক সুনীল সোরেনেরও। তাঁরা বলছেন, “পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দারা দীর্ঘ দিন ধরে আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, রাস্তাঘাট, আলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনওটার হালই সন্তোষজনক নয়। কোনও সামাজিক সুবিধা না থাকলেও রয়েছে দেদার দূষণ!” গোটা অবস্থার জন্য তাঁরা সরকারের সদিচ্ছার অভাবকেই দুষছেন। তাঁদের দাবি, অনুন্নয়নই এলাকায় স্কুলছুট বেড়ে যাওয়ার পিছনে সব থেকে বড় কারণ।

জেলা প্রশাসনের দাবি, পাঁচামি এলাকায় উন্নয়নের কাজ জারি রয়েছে। এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল না থাকা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে জেলা স্কুল পরিদর্শক (উচ্চ মাধ্যমিক) আসরাফ আলি মির্জা বলেন, “পরিস্থিতির দিকে আমাদের নজর আছে। গিড়িজোড় সাঁওতালি উচ্চ বিদ্যালয়কে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করার ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করেছি। আশা করি ইতিবাচক ফল মিলবে।” অন্য দিকে, জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “পাঁচামির খাদান এলাকা স্থানীয় বিডিও-কে সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শন করেছি। শিক্ষা দফতরকে একটি রিপোর্টও পাঠিয়েছি। আশা করছি, নতুন বছর থেকে ওখানে উচ্চ মাধ্যমিক চালু হয়ে যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE