Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সংবর্ধনা সভাতেও প্রকট গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব

জেলার নতুন মন্ত্রীর সংবর্ধনা সভা। সভা হল তৃণমূলের শক্তগড় নানুরে। অথচ ওই সভায় ডাক পেলেন না এলাকারই দুই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। এক জন পাশের কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ এবং অন্য জন তাঁরই ভাই তথা দলের প্রাক্তন জেলা যুব সভাপতি কাজল শেখ। আর তারই জেরে ফের প্রকট হল নানুরে তৃণমূলের দলীয় কোন্দল।

কার্যালয়ে হামলার বিরুদ্ধে হুঙ্কার তৃণমূলের জেলা কমিটির সদস্য বিকাশ রায়চৌধুরী। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

কার্যালয়ে হামলার বিরুদ্ধে হুঙ্কার তৃণমূলের জেলা কমিটির সদস্য বিকাশ রায়চৌধুরী। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নানুর শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০২:২৪
Share: Save:

জেলার নতুন মন্ত্রীর সংবর্ধনা সভা। সভা হল তৃণমূলের শক্তগড় নানুরে। অথচ ওই সভায় ডাক পেলেন না এলাকারই দুই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। এক জন পাশের কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ এবং অন্য জন তাঁরই ভাই তথা দলের প্রাক্তন জেলা যুব সভাপতি কাজল শেখ। আর তারই জেরে ফের প্রকট হল নানুরে তৃণমূলের দলীয় কোন্দল।

ঘটনা হল, রবিবার নানুরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সদ্য মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পাওয়া আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা সভা কার্যত প্রতিবাদ সভার চেহারা নেয়। যার পিছনে রয়েছে গত ১ জুলাই তৃণমূলের নানুর ব্লক কার্যালয়ে ভাঙচুর। যে ঘটনায় নাম জড়িয়েছে দলেরই প্রাক্তন জেলা যুব সভাপতি কাজল শেখ এবং তাঁর অনুগামীদের। এ দিন নাম না করেই দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতারা ওই গোষ্ঠীর উদ্দেশে তীব্র বিষোদগার করেন। এমনকী, তাঁরা দলের কেউ নন বলেও ঘোষণা করেন।

এ দিনের সভায় নানুরের বিধায়ক গদাধর হাজরা, লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরা সভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক পাননি এলাকারই বাসিন্দা, প্রভাবশালী নেতা তথা কেতুগ্রামের বিধায়ক সাহানেওয়াজ। আমন্ত্রণ পাননি তাঁর ভাই কাজল শেখও। আমন্ত্রণ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হলেও সাহানেওয়াজের প্রতিক্রিয়া, “১৯৯৮ থেকে নানুরে ব্লক সভাপতির দায়িত্ব সামলানোর পরেও কয়েক মাস আগে জেলা স্তরে দলের নতুন যে সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়েছে, তাতে আমার জায়গা হয়নি। তার পরে ওই সংবর্ধনা সভায় ডাক না পাওয়াটা আমার কাছে আশ্চর্যের কোনও ব্যাপার নয়।” সম্প্রতি তৈরি হওয়া ওই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি কাজলেরও। দলীয় সূত্রের খবর, অন্যান্য নানা কারণ ছাড়াও এই ঘটনাটিই নানুরে তৃণমূলের সাম্প্রতিক গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করেছে।

তৃণমূলের সূত্রের খবর, সকাল থেকেই নানুর এলাকায় সংবর্ধনার পরিবর্তে দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর এবং পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি মধুসূদন পালকে মারধরের ঘটনায় প্রতিবাদ সভার আয়োজনের খবর চাউড় হয়। দিনের শেষে সভায় হাজির নেতৃত্বের বক্তব্যেও ছিল প্রতিবাদের সুর। কেউ-ই সরাসরি কাজল শেখ এবং তাঁর অনুগামীদের নাম না নিলেও বক্তাদের আক্রমণের লক্ষ্য যে আসলে দু’ভাইয়ের গোষ্ঠীই, তা বারবারই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এমনকী, ওই দুই স্থানীয় নেতার অনুপস্থিতিতে হওয়া ওই সভায় কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতির করুণ হার দেখেও দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছিল।

ব্লক কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং মধুসূদনবাবুকে মারধরের ওই ঘটনায় অভিযোগ ওঠে কাজল-সহ তাঁর ২৩ জন অনুগামীর বিরুদ্ধেই। পুলিশে তাঁদের নামে অভিযোগও দায়ের হয়। যেন তারই প্রতিক্রিয়ায় এ দিন বিকাশবাবু সভাটিকে বারবার ‘প্রতিবাদ সভা’ বলে উল্লেখও করেন। তিনি বলেন, “যাঁরা এই সব ঘটনা ঘটিয়েছে, তাঁরা তৃণমূলের কেউ নন। দুষ্কৃতী মাত্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে তাঁদের কোনও ঠাঁঁই নেই।” একই সুর ছিল মনিরুলেরও। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “রাজ্যে কে নেতা-মন্ত্রী হবেন, তা ঠিক করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই জেলায় কে ব্লক সভাপতি হবেন, কে কী পদ পাবেন, তা ঠিক করবেন আমাদের নেতা অনুব্রত মণ্ডল।”

ঘটনা হল, শেখ সাহানেওয়াজ এবং কাজল শেখ প্রভাবিত নানুরে এ দিনের সভায় দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। অথচ সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটেও নানুর বিধানসভা এলাকায় ৬০ হাজারেরও বেশি লিড পেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু এ দিনের সভায় মেরেকেটে পাঁচশো লোক হয়েছিল। দলীয় তরফে অবশ্য তার পিছনে বৃষ্টিকেই দায়ী করা হচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, ওই সভায় দুই ভাইয়ের ডাক না পাওয়াই কর্মী-সমর্থকদের কম উপস্থিতির কারণ। তাই ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর সাম্প্রতিক অতীতে এই ঘটনা বিরল বলেই মনে করছে দলেরই একটি অংশ। তাঁদের ব্যাখ্যা, সাহানেওয়াজ এবং কাজলের ‘নিষ্ক্রিয়তা’র জেরেই এ দিনের সভায় কর্মী-সমর্থকদের তেমন ভিড় হয়নি। এ দিনের সভা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, সাহানেওয়াজ বলেন “লোকসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ভাইকে নিয়ে দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে হবে। সেই মতো দুই ভাই জান লড়িয়ে দিয়েছি। কোনও প্রতিদানের আশা আগেও করিনি, এখনও করি না।” যদিও তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একটি সূত্রের দাবি, দলের কোনও পদে জায়গা না মেলাতে ক্ষোভেই দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে তাঁর ও কাজলের অনুগামীরা। দু’জনে অবশ্য সেই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন।

এ দিকে, স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশের পাশাপাশি জেলা তৃণমূলের একটি অংশেরও মত, নানুরে তৃণমূলের উত্থানের পিছনে সাহানেওয়াজ-কাজলের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সিপিএমের হাতে তাঁদের দুই ভাই খুন হন বলে অভিযোগ। দীর্ঘ দিন তাঁদের সপরিবারে গ্রামছাড়াও হতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নানুর ব্লকে যে দু’টি পঞ্চায়েত তৃণমূল জোট দখল করতে পেরেছিল, তার একটি হল সাহানেওয়াজ যে পঞ্চায়েতের বাসিন্দা, সেই চারকল গ্রাম। এমনকী, নানুরে সুচপুরে নিহত ১১ জন তৃণমূল সমর্থক খেত মজুরদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাসাপাড়ায় শহিদ স্মরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতবার এসেছেন, প্রায় প্রতিবারই সাহানেওয়াজকে দলের ‘সৈনিক’ বলে উল্লেখ করতে শোনা গিয়েছে। কিন্তু সেই সৈনিকই এখন দলের একটি অংশের বিষনজরে পড়েছেন বলে খবর। সংবর্ধনা সভার অন্যতম উদ্যোক্তা তথা দলের নানুর ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যের বক্তব্যেও তা অনেকটাই পরিষ্কার। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “কাজল শেখ দল বিরোধী কাজ করছেন। তার পরে ওঁকে সভায় ডাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সাহানেওয়াজও প্রকাশ্যে তাঁর ভাইয়ের কার্যকলাপকে সমর্থন জানানোয় তাঁকেও ডাকা হয়নি।”

সব মিলিয়ে ক্ষোভ থাকলেও এ দিনের সভাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ কাজলও। তিনি স্পষ্টই বলেন, “মনিরুল ইসলামের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গেল, দলে কর্মী-সমর্থকদের মতামতের কোনও গুরুত্বই নেই। দলের জেলা সভাপতি যাঁকে যেমন নাচাবেন, তাঁকে তেমনই নাচতে হবে। ওরা ভুলে যাচ্ছেন কাজল শেখ কারও হাতের পুতুল হতে রাজি নয়।”

“কাজল দল বিরোধী কাজ করছেন।
ওঁকে সভায় ডাকার প্রশ্নই ওঠে না।”
সুব্রত ভট্টাচার্য।
​তৃণমূলের নানুর ব্লক সভাপতি

“দলের জেলা সভাপতি যাঁকে যেমন নাচাবেন, তাঁকে তেমনই নাচতে হবে।
আমি কারও হাতের পুতুল হাতে রাজি নই।”
কাজল শেখ।
তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা যুব সভাপতি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nanur Groups - conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE