কবে থামবে? মাড়গ্রামে অবাধে হুকিং। —নিজস্ব চিত্র
এলাকায় বিদ্যুৎ যায় ১১০ মেগা ইউনিট। অথচ আয় আসে মাত্র ১৯ মেগা ইউনিটের। নিট ফল ৮২ শতাংশ ক্ষতির ধাক্কা!
এই হিসেব বীরভূমেরই একটি বিদ্যুৎ গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের। না, পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির মুরারই বিদ্যুৎ গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রে ক্ষতির এই নিদর্শন কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কোম্পানির দেওয়া তথ্যই বলছে, জেলার ১৯টি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের অধিকাংশেরই কমবেশি একই অবস্থা। যার জেরে এই জেলায় কোম্পানির সংবহন ও বাণিজ্যিক ক্ষতির (এগ্রিগেট ট্রান্সমিশন অ্যান্ড কমার্সিয়াল লস, সংক্ষেপে এটিসি লস) হার বেড়েই চলেছে। চলতি ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরেই এখনও পর্যন্ত শুধু বীরভূমেই সেই ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ছাড়িয়েছে। এই বিপুল ক্ষতির নেপথ্যে মূলত বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে ব্যর্থতাকেই দুষছেন কোম্পানির একাংশের কর্তারা।
কোম্পানি সূত্রে খবর, গত কয়েক বছর ধরেই জেলার ১৯টির মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যুৎ গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রই লোকসানে চলছে। এর মধ্যে ৬টি কেন্দ্রে ক্ষতির পরিমাণ ৭০ শতাংশেরও বেশি। সেই তালিকায় রয়েছে মুরারই, ইলামবাজার, কীর্ণাহার, লাভপুর, নলহাটি ও মাড়গ্রামের নাম। আবার রামপুরহাট কেন্দ্রে ৫৫%, শান্তিনিকেতন কেন্দ্রে ৪০%, সিউড়ি (পশ্চিম) কেন্দ্রে ৩৯% এবং চন্দ্রপুর কেন্দ্রে কোম্পানির বাৎসরিক সেই ক্ষতির পরিমাণ ৩৫%। জেলার বাকি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের চেয়ে আয়ের পরিমাণের বাৎসরিক গড় ৫০-৫৫ শতাংশের মধ্যে থাকছে। কোম্পানির জেলা রিজিওন্যাল মানেজার তপনকুমার দে বলছেন, “আমরা বিভিন্ন ভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। মিটারে কারচুপি রুখতে অভিযান যেমন চলছে, তেমনই বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টাও করা হচ্ছে। আশা করছি, এ বছরের শেষে গিয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমাতে পারব।”
এই বিপুল ক্ষতির নেপথ্যে বিভিন্ন উপায়ে দেদার বিদ্যুৎ চুরিকেই দায়ী করছেন কোম্পানির কর্তারা। দেখা যাচ্ছে সে সব অঞ্চলে গভীর নলকূপে সেচের ব্যবহার বেশি, সেখানে ব্যাপক হারে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে মিটারে কারচুপি। পাশাপাশি ওই কর্তারা মেনে নিচ্ছেন, বিদ্যুৎ চুরির পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মিটার রিডিংয়ের ত্রুটি ও বিল আদায়েও গাফিলতি রয়েছে। সঙ্গে জনবিন্যাস-সহ বিবিধ আর্থ-সামাজিক কারণ। উপরন্তু গ্রামীণ গ্রাহকের সংখ্যা বাড়লেও অনেকে সময়ে তাঁরা বিল মেটাতে অপারগ। তার উপরে ২০১১ সালে মগরাহাট-কাণ্ডের পরে হুকিং-রোধ অভিযানও কার্যত বন্ধ। সব মিলিয়ে গোটা রাজ্যেই কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির বহর দিন দিন বাড়ছে। ব্যতিক্রম নয় এই জেলাও। জেলার এক কর্তার ক্ষোভ, “ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে। চাষিদের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ব্যবহারে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকেরা যেন ‘লোডশেডিং’ শব্দটাই ভুলে যান, সে দিকেও নজর দিতে হবে। সরকারের এই তিন লক্ষ্য পূরণে আমরা তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছি। কিন্তু সেই অনুযায়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে মানুষ নিজেদের স্বার্থেই সে ভাবে সচেতন হচ্ছেন কই? বিদ্যুৎ ব্যবহার অনুযায়ী বিদ্যুতের পয়সা দিতে হবে, বিদ্যুৎ চুরি রুখতে হবে, বিদ্যুৎ অপচয় রুখতে হবে, হুকিং করা চলবে না জেলায় গ্রাহকদের কাছে বারবার এ নিয়ে প্রচার করেও আর্থিক ক্ষতি আটকানো যায়নি।”
দেখা গিয়েছে, এই জেলার রাজনগর, সিউড়ি (পশ্চিম), মহম্মদবাজার এলাকায় সেচের জন্য বিদ্যুৎ চালিত নলকূপের ব্যবহার কম। সেখানে ক্ষতির পরিমাণ মুরারই, নলহাটি ও মাড়গ্রাম গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রগুলির থেকে কম। কারণ, শেষোক্ত তিন কেন্দ্রে সেচের জন্য বিদ্যুৎ চালিত নলকূপের ব্যবহার বেশি। এবং ওই নলকূপগুলির বিদ্যুৎ সংযোগের সংখ্যাগরিষ্ঠই বেআইনি বলে জানা গিয়েছে। কোম্পানির আধিকারিকদের অভিযোগ, রামপুরহাট মহকুমার ওই তিন কেন্দ্রের ক্ষেত্রে আবার এমনটাও দেখা গিয়েছে, যে সব ক্ষেত্রে সংযোগ রয়েছে তাদের অনেকেই মিটারে কারচুপি করেও বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন। যার জেরে কোম্পানির যে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে, বিনিময়ে সমপরিমাণ আয়টুকুও হচ্ছে না। ফলে চাষিদের বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক পার্থক্য ধরা পড়ছে। গভীর নলকূপ চালাতে বিদ্যুৎ খরচ বাবদ এলাকার কোনও চাষি যখন সারা বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কোম্পানিকে দিচ্ছেন, আবার অনেকেই সেই খরচ দেখাচ্ছেন মাত্র ১২০০-১৫০০ টাকা। আবার খরিফ মরসুমে বোরো ধানের চাষের জন্য কিছু চাষিকের কোম্পানি অস্থায়ী ভাবে তিন মাসের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। এ ক্ষেত্রেও রাতের অন্ধকারে মিটার ব্যবহার না করে বিদ্যুৎ চুরি করা হয় বলে অভিযোগ। সেই ‘ফাঁকি’র চোটে বেড়েই চলেছে ক্ষতির পরিমাণ। নলহাটি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের সহকারী বাস্তুকার সুপ্রিয় দে-র অভিজ্ঞতা, “এ বছর সাপ্লাই অফিস থেকে সেচের জন্য ৩০০০ গ্রাহককে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে দেখা গেল প্রায় ৫০০০ চাষি বিদ্যুৎ টানছেন। বেশির ভাগটাই চুরি করে। যার জেরে লো-ভোল্টেজের সমস্যা দেখা দিয়েছিল।”
শুধু কী তাই? হুকিং বন্ধে কোম্পানি গঠিত ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড লস প্রিভেনশন সেলে’র দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, গ্রামাঞ্চলে আগের চেয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সেখানে মিটারে যাতে ‘এনার্জি কাউন্ট’ না হয়, তার জন্য আগেই সার্ভিস কেবলের তার কেটে দিয়ে অবৈধ ভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাত নামতেই মিটার বন্ধ করে হুকিং করা হচ্ছে। ওই সব গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। গত ৩ মার্চই কোম্পানির রামপুরহাট ডিভিশনের ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড লস প্রিভেনশন সেল’ মাড়গ্রাম থানার রমানাথপুরে একটি বাড়িতে অবৈধ ভাবে দু’টি হিটার ব্যবহার হতে দেখে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে কোম্পানি এফআইআর দায়ের করেছে। যদিও উল্টো দিকে, মাড়গ্রাম থানার কানাইপুর, নলহাটি থানার ধরমপুর, মুরারই থানার দাঁতুড়ার মতো এলাকাগুলির বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করেও মেলেনি। তাই বাধ্য হয়েই এলাকার একাংশের বাসিন্দা হুকিং করেছেন।
তপনবাবু অবশ্য ওই অভিযোদ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “এখন গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গ্রামীণ পরিকাঠামো বিভাগ তাতে ভাল কাজ করছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে নিচুস্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থা কাজ করতে গড়িমসি করে। তার জন্যই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।” আবেদন করেও বিদ্যুৎ সংযোগ না মেলার ক্ষেত্রে আবেনকারীরা সুনির্দিষ্ট ভাবে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কোম্পানির গ্রামীণ পরিকাঠামো বিভাগের জেলা প্রকল্প আধিকারিক প্রদীপকুমার নাগ। একই সঙ্গে বাড়তি খরচ কমাতে ইতিমধ্যেই মুরারই ও মাড়গ্রামে দু’টি পৃথক সাবস্টেশন তৈরির প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে বলেও কোম্পানি সূত্রে খবর।
এই বিপুল ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে নতুন কিছু ব্যবস্থাও কোম্পানি নিতে শুরু করেছে। যেমন, মিটার রিডিং নিয়ে বিল তৈরির সাবেক পদ্ধতির পরিবর্তে চালু হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে ‘স্পট বিলিং।’ কর্তাদের দাবি, এটিসি লসের হার স্রেফ ১% কমাতে পারলেই বছরে প্রায় ৬০ কোটির বাড়তি রাজস্ব ঘরে তোলা সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy