অশোকনগরে বিজেপি নেতৃত্ব। ছবি: শান্তনু হালদার।
গত লোকসভা ভোটের আগে শ্রীরামপুর এসে তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের পরে যারা বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁদের বাক্সপত্তর-সহ ও দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
মোদীর সেই বক্তব্যে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। রাজনৈতিক মহলেও আলোড়ন শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময়ে মোদীর পাল্টা হিসাবে জানিয়ে দেন, তিনি এ রাজ্যের বাসিন্দাদের পাহারাদার হিসাবে বসে থাকবেন। সকলে যেন নিশ্চিন্তে বাড়িতে থাকেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে পরে বিজেপি নেতৃত্ব বলতে শুরু করেন, মোদীর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এ রাজ্যে আরও দু’টি সভায় মোদীও জানান, ওই ধরনের কোনও কিছু তিনি বোঝাতে চাননি। বরং উদ্বাস্তুদের জন্য আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে যা করা যায়, তা-ই করা হবে। বস্তুত, রাষ্ট্রসঙ্ঘ অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থী প্রসঙ্গে যে পার্থক্য করেছে, তাকে কাজে লাগিয়েই বিজেপি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।
বৃহস্পতিবার অশোকনগরের সভা থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলে গিয়েছেন, ‘‘উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার চিন্তা করার কেউ ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী এ রাজ্যের একটি সভায় এসে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের আমরা নাগরিকত্ব দেবো। এই ভরসা আমরা আপনাদের দিচ্ছি। শরণার্থী উদ্বাস্তুরা যাতে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারেন, সে জন্য আমরা নিয়মের পরিবর্তন করছি।’’
মতুয়া ভোটার অধ্যুষিত উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় উদ্বাস্তু প্রসঙ্গে রাজনাথের এই বক্তব্যই প্রত্যাশিত ছিল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। শুধু রাজনাথই নন, বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ— সকলের বক্তব্যেই উঠে এসেছে উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গ।
বাংলাদেশ থেকে আসা বহু উদ্বাস্তু মানুষের এখনও নাগরিকত্ব পাননি। ভোটার তালিকায় নাম ওঠেনি। ধর্মীয় কারণে ও পার বাংলা থেকে আসা মানুষদের নাগরিকত্বের দাবিতে সারা ভারত মতুয়া মহা সঙ্ঘ বহু দিন ধরেই লড়াই করছে। এ রাজ্যে ৭২টি বিধানসভা কেন্দ্র তপসিলি ও মতুয়া প্রভাবিত মানুষ বসবাস করেন। নির্বাচনের ফলাফলে তাঁদের ভূমিকা থাকে। ফলে বিধানসভা ভোটের আগে ডান-বাম সকলেই ওই ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করে থাকে।
এ দিনের সভায় দিলীপবাবু বলেন, ‘‘ও পার বাংলা থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্ত মানুষের এখনও সম্মান নেই। তাঁদের ভোটাধিকার নেই। কংগ্রেস-সিপিএম বা তৃণমূল কেউ তাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে কথা বলে না। আমাদের সংকল্প, আমরা তাদের নাগরিকত্ব দেবো।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘২০১৪ সালের ডিসেম্বরের আগে ও পার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কেউ তাড়াতে পারবে না। তাঁদের আমরা নাগরিকত্ব দেবো।’’
একধাপ এগিয়ে রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘কংগ্রেস উদ্বাস্তুদের তাড়াতে শুরু করেছিল। সিপিএম প্রচেষ্টা করেছে। ও পার বাংলা থেকে আসা হিন্দু, মতুয়ারা এখানে থাকবেন।’’
মতুয়ারা উদ্বাস্তদের নাগরিকত্বের দাবিতে বহু দিন ধরেই আন্দোলন করছেন। বনগাঁ লোকসভা ভোটের আগে গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে মতুয়া বাড়ির ছোট ছেলে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুর উদ্বাস্তু হিন্দু ও মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবিতে অনশন শুরু করেন। পরে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে অনশনকারীদের আশ্বাস দিলে অনশন তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সুব্রত উপনির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীও হয়েছিলেন।
সম্প্রতি ওই একই দাবিতে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘ কলকাতা ও দিল্লিতে আন্দোলন করেছে। সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বনগাঁর সাংসদ তৃণমূলের মমতাবালা ঠাকুর এ দিন বিজেপি নেতাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বলেন, ‘‘মৌখিক প্রতিশ্রুতির কোনও গুরুত্ব নেই। আমাদের দাবি, ধর্মীয় কারণে যাঁরা ও পার বাংলা থেকে এখানে এসেছেন, তাঁদের দ্রুত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য কেন্দ্র সরকারকে সংসদে বিল আনতে হবে।’’
জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক উদ্বাস্তু প্রশ্নে জানিয়েছেন, উদ্বাস্তু ও মতুয়াদের নাগরিকত্বের জন্য যা লড়াই করছেন, তা একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। ভোটের আগে বিজেপি নেতারা এখন ‘মায়া কান্না’ কাঁদতে এসেছেন বলে কটাক্ষও করেন তিনি।
রাজনৈতিক মহল মনে করছেন বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মতুয়া ও উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে আরও বেশি করে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে দাবি, পাল্টা দাবি দেখা যাবে। কারণ, মতুয়াদের দাবি-দাওয়াকে অস্বীকার করে এই জেলায় ভোট বৈতরণী পার হওয়া মুশকিল, সে কথা জানে সব পক্ষই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy