Advertisement
E-Paper

রাতেও শুনেছি গলা, সকালে তারা আর নেই

ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। একটা বুকফাটা আর্তনাদ যেন আমার ঘরটার চারপাশে পাক খাচ্ছে। পাহাড়ের কোলে বাড়ি। মনে হল পাহাড়টাই যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিছুক্ষণ সব চুপ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। তারপর আবার সেই আওয়াজ— গুমগুম, গুমগুম। একটা দৈত্যাকার হাতুড়ি পিটছে যেন কেউ। আওয়াজটা কমে আসতে এ বার মানুষের গলায় হইহল্লা শুনলাম।

লিলন থাপা

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৭
ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন লিলন থাপা। — নিজস্ব চিত্র

ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন লিলন থাপা। — নিজস্ব চিত্র

ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। একটা বুকফাটা আর্তনাদ যেন আমার ঘরটার চারপাশে পাক খাচ্ছে। পাহাড়ের কোলে বাড়ি। মনে হল পাহাড়টাই যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

কিছুক্ষণ সব চুপ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। তারপর আবার সেই আওয়াজ— গুমগুম, গুমগুম। একটা দৈত্যাকার হাতুড়ি পিটছে যেন কেউ। আওয়াজটা কমে আসতে এ বার মানুষের গলায় হইহল্লা শুনলাম। আতঙ্কিত চিৎকার— মনে হল পাহাড়ের নীচের ঢাল থেকে উঠে আসছে। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপতে আলো জ্বলল না। মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে একটা ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লাম। রাত তখন আড়াইটে। পাশেই আমার মামার বাড়ি। সে দিকে আলো ফেলতেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।

মামাদের বাড়িটাই নেই!

শুধু ওই বাড়িটা নয়, তার পাশের আরও চারটে বাড়িরও কোনও চিহ্ন নেই। তত ক্ষণে বুঝতে পারছি, ধস নেমেছে। মিরিকের এই টিংলিঙে আমার চিরচেনা ঘরবাড়ি-ঘাস-মাটি-গাছ-রাস্তা— সব গুঁড়িয়ে গিয়েছে পাহাড় থেকে নেমে আসা টন টন পাথরে। কিংবা মামার বাড়িটার মতোই তলিয়ে গিয়েছে অতলে।

হঠাৎ হুঁশ হল, আমার বাড়ির কী অবস্থা? বরাতজোরে আমি, আমার বৌ-ছেলে না হয় বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু বাড়িটা? পেছন ফিরে টর্চ ঘোরাতে দেখি, রান্নাঘরটার মাঝখান দিয়ে যেন নিপুণ হাতে ছুরি চালিয়েছে কেউ। পা কাঁপছে। মনে হল পাহাড়ের নীচ থেকে একটা সমস্বর আর্তনাদ উঠে এসে মিলিয়ে গেল পাইন বনে।

কাদা-পাথরের স্তূপ ডিঙিয়ে অনেকেই দৌড়োদৌড়ি করছে তখন। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এগিয়ে চললাম। সম্বল ওই একটা মোবাইল টর্চের আলো। সেই আলোতেই দেখলাম, পাহাড়ের ওপরের ঢাল থেকে নেমে আসা ছোট-বড় বাড়ি, গাছপালা দুমড়েমুচড়ে পড়ে রয়েছে নীচের বস্তিতে।

ও দিকে আলো ঘোরাতেই মানুষটাকে দেখতে পেলাম। ভাঙা গাছের ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে। দেখেই বুঝলাম, প্রাণ নেই। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। তার পর আবার এগোতে যাব, দেখলাম একটু দূরেই কাদামাটির স্তূপের নীচ থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটা হাত।

বুজে আসা গলা থেকে চিৎকারটাও বেরোল না। মনে হল জ্ঞান হারাচ্ছি। একমাত্র ঘড়ির কাঁটাটা এগিয়ে চলেছে নিজের খেয়ালে। গোটা রাত জেগে বসে রইলাম। আবার যদি জেগে ওঠে দানবটা, জানতে পারব না যে! তার পর এক সময়ে আলো ফুটল। আর দেখলাম, ছবির মতো গ্রামটাকে যেন এলোমেলো হাতে ইরেজার চালিয়ে মুছে দিতে চেয়েছে কেউ।

আমি এই পাহাড়েরই ছেলে। আমার জন্ম টিংলিঙের লিম্বুগাঁওয়ে। কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা। পাহাড়ের ঢালের ভাঁজে ছোট-বড় বাড়ি, পিছনে পাইন-ঝাউয়ের বন। এক পাশের ঢালে চা বাগান। দেখলে মনে হবে রং-পেনসিলে আঁকা।

ভুল বললাম। মনে ‘হতো’! বুধবার ভোর থেকে তো দেখছি, আকাশছোঁয়া ওই গাছগুলোকে কেউ যেন পাটকাঠির মতো উপড়ে নিয়েছে। যেখানে সার দিয়ে বাড়ি ছিল, সেখানে ইট-কাঠের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। আমাদের বাড়ির পাশে এতগুলো পরিবার থাকত। তারা কেউ কোত্থাও নেই। শুধু কোথাও পড়ে একপাটি চটি-জুতো, কোথাও বালিশের ওয়াড়। একটা খাটালে চারটে গরু ছিল, সেগুলোরও চিহ্ন নেই।

তত ক্ষণে পুলিশ, বিডিও অফিসের লোকজন আসতে শুরু করেছে। একে একে উদ্ধার হল ১১টা মৃতদেহ। শুনলাম আমাদের পাড়ার আরও ৮ জনের খোঁজ নেই (পরে অবশ্য ওঁদের নিয়েই টিংলিঙে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯)। বুকটা মুচড়ে উঠছে মামা-মামি আর ফুটফুটে ভাগ্নি দু’টোর জন্য। বিডিও অফিসের দেওয়া মৃতের তালিকায় গোটা পরিবারটারই নাম উঠেছে।

আমার মামা সুভাষ আলে এখানে একটা স্কুল চালাতেন। রোজ রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে ওঁদের বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ পড়তাম, গল্পগুজব হতো। মঙ্গলবার সন্ধে থেকেই ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। রাত ৯টা থেকে জোরে বৃষ্টি নামে। তাই আর মামার বাড়ি যাইনি। খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলাম। এক বার শুধু বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙেছিল। তার পরেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এর পর তো ঘুম ভাঙল সেই পাহাড়-ভাঙা ভয়ঙ্কর আওয়াজে।

বৌ-ছেলেকে এ দিনই শিলিগুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ছন্নছাড়া ভিটে আগলে পড়ে রয়েছি আমি। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পাশের বাড়ি থেকে যে মানুষগুলোর গলার আওয়াজ পেয়েছি, কয়েক ঘণ্টায় তারা চিরতরে হারিয়ে গেল— এটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। কত গান, কত গল্পে গমগম করত আমাদের টিংলিং। এখন একটা খাঁখাঁ নৈঃশব্দ ঘিরে ফেলেছে এলাকাটাকে।

সকাল থেকে উদ্ধারকারী দলের হইহল্লাও সেটাকে চাপা দিতে পারেনি।

(লেখক প্রত্যক্ষদর্শী, পর্যটন দফতরের কর্মী)।

Lilan Thapa landslide Darjeeling hill' dooars MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy