রেণু খাতুন। নিজস্ব চিত্র।
স্বাধীন ভাবে বাঁচব, স্বাধীন ভাবে কাটাব জীবন— ইচ্ছেটা বরাবরের। একটা অন্ধকার রাত থাবা বসিয়েছিল সেই ইচ্ছেয়। কিন্তু লড়াই করার ইচ্ছেটা হারাতে দিইনি।
আমি রেণু খাতুন। পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। কারও উপরে নির্ভরশীল থাকব না— এমন চিন্তা ছোটবেলা থেকেই। পড়াশোনা করে মানুষের সেবামূলক কাজ করতে চেয়েছিলাম। কেতুগ্রামের কান্দরা রাধাকান্ত কুণ্ডু কলেজে পড়াশোনা শেষ করেই নার্স হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে আরজি কর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। নার্স হওয়ার পরে বেসরকারি হাসপাতালে কাজের সুযোগ পাই। সরকারি হাসপাতালে নার্সের জন্য মনোনীত হয়ে তালিকায়ও নাম ওঠে। এর পরেই নেমে এল বিপর্যয়।
গত ৪ জুন গভীর রাতে বাড়িতে ঘুমিয়েছিলাম। আমাকে নার্সের চাকরি করতে না দেওয়ার জন্য ডান হাতের কব্জি কেটে নেয় স্বামী শের মহম্মদ ও তার সঙ্গীরা। দুর্গাপুরের হাসপাতালে থাকার সময়ে বুঝতে পারছিলাম, এ বার মনে জোর এনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে অন্যের উপরে নির্ভর করতে হবে। তখনই ঠিক করি, আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এ কথা ভেবেই বাঁ হাতে লেখার অভ্যাস শুরু করি।
আমার লড়াইয়ের কথা জেনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান সফরে এসে দেখা করেন। এখন নার্সের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। প্রায় তিন সপ্তাহ পূর্ব বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতরে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। ১৫ জুলাই থেকে বর্ধমানের নার্সিং স্কুলে ‘ম??েন্টর’ হিসেবে কাজ করছি। নার্সের প্রশিক্ষণ নেওয়ার দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। এতগুলি মেয়েকে কাছে পেয়েছি, যা খুব আনন্দের। ওদের শুধু বলতে চাই, পুরনো ঘটনা মনে না রেখে, বরং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
যদিও মনে হয়, এই লড়াইয়ের সবটুকু সাফল্য কি পেয়েছি? আমাদের সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা কতটুকু, সে প্রশ্নও জাগে। নিজের ইচ্ছেমতো পড়াশোনা করা, পছন্দসই পেশা বেছে নেওয়া, বিয়েতে সম্মতি বা অসম্মতি— এ সবে মতামত দেওয়ার কতটা স্বাধীনতা রয়েছে অধিকাংশ মেয়ের? আমার কাছে স্বাধীনতার অর্থ, মেয়েরা স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। সে জন্য তাঁদের হিংসার শিকার হতে হবে না। কেউ অ্যাসিডে আক্রান্ত হবেন না।
স্কুলে পড়ার সময়ে স্বাধীনতা দিবসে আবৃত্তি করতাম। নার্সের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়ে পতাকা উত্তোলনের জায়গা ফুল দিয়ে সাজাতাম, মিষ্টি কিনতে দোকানে ছুটতাম। এ বছর আমি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং কলেজে গিয়ে বাঁ হাতে লেখা নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাব। কোনও অনাথ আশ্রমে যাব বলেও ঠিক করেছি। সেখানকার আবাসিকদের দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই আমার কাছে। স্বাধীনতার দিনে ভালবাসা তো দিতে পারব।
অনুলিখন: সৌমেন দত্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy