Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বাপি-মামলা

আইনজীবীরা দু’ভাগ, দ্বন্দ্ব দলের অন্দরেও

শাসক দলও দু’ভাগ, আইনজীবীরাও দু’ভাগ। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করে গ্রেফতার হওয়া যুবক বাপি পালকে ঘিরে মালদহে এখন রীতিমতো অন্তর্কলহের আবহ। মঙ্গলবার রাতে হরিশ্চন্দ্রপুর থানা গ্রেফতার করেছিল বাপিকে। বুধবার চাঁচল আদালতে তোলা হলে বাপির হয়ে কোনও আইনজীবী দাঁড়াতে চাননি বলে অভিযোগ। করা হয়নি জামিনের আবেদনও। বিচারক বাপিকে তাই ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে হইচইয়ের পরে বৃহস্পতিবার স্থানীয় তৃণমূল এবং চাঁচল বার অ্যাসোসিয়েশন, দু’জায়গাতেই দোষারোপের পালা শুরু হয়ে গিয়েছে।

বাপির সঙ্গে দেখা করার পর বাবা মুকুল পাল। বৃহস্পতিবার মালদহ জেলা সংশোধনাগারের সামনে মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বাপির সঙ্গে দেখা করার পর বাবা মুকুল পাল। বৃহস্পতিবার মালদহ জেলা সংশোধনাগারের সামনে মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
হরিশ্চন্দ্রপুর (মালদহ) শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

শাসক দলও দু’ভাগ, আইনজীবীরাও দু’ভাগ। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করে গ্রেফতার হওয়া যুবক বাপি পালকে ঘিরে মালদহে এখন রীতিমতো অন্তর্কলহের আবহ।

মঙ্গলবার রাতে হরিশ্চন্দ্রপুর থানা গ্রেফতার করেছিল বাপিকে। বুধবার চাঁচল আদালতে তোলা হলে বাপির হয়ে কোনও আইনজীবী দাঁড়াতে চাননি বলে অভিযোগ। করা হয়নি জামিনের আবেদনও। বিচারক বাপিকে তাই ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে হইচইয়ের পরে বৃহস্পতিবার স্থানীয় তৃণমূল এবং চাঁচল বার অ্যাসোসিয়েশন, দু’জায়গাতেই দোষারোপের পালা শুরু হয়ে গিয়েছে।

এলাকায় বাপি ও তাঁর পরিবার তৃণমূল কর্মী বলেই পরিচিত। বাপির পরিবারের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বক্তব্য, বাপি যখন ক্ষমা চেয়েছিলেন, তার পরে তাঁকে গ্রেফতার করানোর দরকার ছিল না। তাঁদের বক্তব্য, তাপস পাল ক্ষমা পেলে বাপিও পেতে পারেন। এ দিন সংশোধনাগারে বাপিকে দেখতে যান তৃণমূলের যুব সংগঠনের এক নেতা। বাপির জামিনের ব্যাপারে তদ্বির করতে আদালতেও এসেছিলেন শাসক দলের কয়েক জন। তাঁদের অভিযোগ, অন্য কয়েক জন তৃণমূল নেতার চাপেই পুলিশ বাপিকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করেছে। অপরাধীর মতো হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করেছে। বাপিকে ক্ষমা করা না-হলে ওই নেতা-কর্মীরা দল ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

অন্য দিকে যাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে বাপি গ্রেফতার হন, তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের মালদহ জেলার সভাপতি সেই জহিরুল ইসলাম শীতল এ দিন দাবি করেন, “বাপিরা তৃণমূলের কেউ হতে পারে না। ওদের যাতে সংগঠন থেকে বের করে দেওয়া হয় সেই ব্যাপারে রাজ্য নেতৃত্বকে জানাব।” তৃণমূলের মালদহ জেলা সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বক্তব্য, “যাঁরা দিদির বিরুদ্ধে কুৎসা করেন, তাঁরা দলের কেউ হতে পারেন না। আমি নাম জানতে পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”

প্রায় একই ছবি বার অ্যাসোসিয়েশনেও। অভিযুক্ত কেন আইনজীবীর সাহায্য পাবেন না, তাই নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে সংবাদমাধ্যম। সরব হয়েছেন বিরোধীরা। বুধবার চাঁচল বার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক তথা অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি গোলাম মুস্তাফা কামাল দাবি করেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করায় ধৃতের হয়ে দাঁড়াতে চাননি আইনজীবীরা। যদিও এর পিছনে রাজনৈতিক চাপ কাজ করছে বলেই অভিযোগ উঠেছিল স্থানীয় স্তরে। এ দিন একই সুরে গোলামের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন বার অ্যাসোসিয়েশনের অপর যুগ্ম সম্পাদক এবং সহ সভাপতি-সহ আইনজীবীদের একাংশ।

এ দিন নিজেরাই বাপির জামিনের জন্য সচেষ্ট হন অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি হিমাদ্রিশেখর দাস, যুগ্ম সম্পাদক খাইরুল আনাম এবং আইনজীবী ফারুক শাহ। চাঁচল মহকুমা আদালতের ভারপ্রাপ্ত এসিজেএম তনুময় কর্মকারের কাছে যান তিন জন। কিন্তু আদালতে এখন পুজোর ছুটি চলছে। ছুটি শেষ না হলে জামিনের আবেদন করা যাবে না বলে আইনজীবীদের জানিয়েছেন বিচারক। তবু শুক্রবার ধৃতের মাকে দিয়ে ফের এক বার জামিনের আবেদন জানানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানা গিয়েছে।

খাইরুল সাহেব এ দিন বলেন, “গোলাম মুস্তাফা কামাল যা বলেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। অ্যাসোসিয়েশনে বাপির হয়ে না দাঁড়ানো নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সংগঠনের নাম করে এ ধরনের কথা বলাও ঠিক হয়নি।” হিমাদ্রিবাবু দাবি করেন, বুধবার ধৃতের হয়ে জামিনের আবেদন করা হবে বলেই ঠিক হয়েছিল। তখন মুস্তাফা সাহেব নিজে জামিনের আবেদন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় তিনি তা করেননি। যদিও নিজে অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি হয়ে মুস্তাফা সাহেব কী করে ধৃতের জামিনের আবেদন করতেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। হিমাদ্রিবাবুর অভিযোগ, “আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এটা করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।” গোলাম মুস্তাফা অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করেননি। তাঁর দাবি, “সাংগঠনিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয়নি ঠিকই। কিন্তু বুধবার যে আইনজীবীরা আদালতে ছিলেন, তাদের কেউ ধৃতের হয়ে মামলা লড়তে রাজি হননি। বাইরে কে কী বলছেন, তা জানি না।”

এ দিন সকালে স্ত্রীকে নিয়ে মালদহ সংশোধনাগারে ছেলেকে দেখতে যান বাবা মুকুল পাল। ছেলের কান্নাকাটি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এ দিন জানকীনগরে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সর্বত্রই একই আলোচনা। ধৃতের মেজো দাদা দেবু পাল বলেন, “ভাই জীবনে কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করেনি। কী যে হয়ে গেল!” কাকা সুশীল পাল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ছেলেটা ঝোঁকের বশে অন্যায় করে ফেলেছে। আমরা তো ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। তার পরেও ওকে জেলে কাটাতে হচ্ছে।”

বাপিকে এই ভাবে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে রাজ্য সরকার দ্বিচারিতা করেছে বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরাও। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বৃহস্পতিবার বলেন, “রাজ্য সরকার বাপি পালকে গ্রেফতার করতে যতটা তৎপর, ততটাই তৎপর তাপস পালকে বাঁচাতে।” বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্য করলে পুলিশ সক্রিয় হয়। কিন্তু তাপস পাল যখন মা-বোনেদের অপমান করেন, কোনও তৃণমূল নেতা যখন পুলিশকে বোমা মারতে বলেন, তখন কেন পুলিশ ব্যবস্থা নেয় না?” মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি সমর্থন না করেও রাহুলবাবুর মত, “তৃণমূল কর্মীরাই মুখ্যমন্ত্রীকে বেশি অপমান করলেন। বিষয়টা পুলিশ এবং আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে না গেলে ঘটনাটার এত প্রচার হতো না।”

বাপি পালের মতোই তৃণমূল যুবা সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তাঁকে ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে গালি দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ ধরেছিল কৃষ্ণনগরের অভিষেক দাসকে। অভিষেক অবশ্য জামিন পেয়েছেন। বুধবার রাত দেড়টা নাগাদ তাঁকে পিএস বেল-এ মুক্তি দেওয়া হয়। শুক্রবার তাঁকে ব্যাঙ্কশাল আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে বলে জানান অভিষেকের আইনজীবী সুমন দাস। তিনি বলেন, “এমএ পাশ করার পর নানা চাকরির পরীক্ষা দিয়েও অভিষেক চাকরি পাননি। সেই হতাশা থেকেই তিনি কাজটা করে ফেলেছেন।” যদিও কৃষ্ণনগর পুরসভার‌ তৃণমূল কাউন্সিলর তথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি অয়ন দত্তের দাবি, “এই ধরনের ছেলেদের কঠিন সাজা হওয়া উচিত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE