সেই পুরনো কিস্সা। দুষ্কৃতীরাজের দাপটে প্রকল্পে হোঁচট। এবং অভিযুক্তদের মাথায় শাসকের আশীর্বাদী হাতের ছায়া! সেই সঙ্গে দায় এড়ানোর তৎপরতা।
এ বার বিতর্কের কেন্দ্রে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশেষ করে বলতে গেলে তার পাঁচশো মেগাওয়াট ক্ষমতার তৃতীয় ইউনিটটি। লক্ষ্যমাত্রার দু’বছর পিছনে থেকে মাস ছয়েক আগে যার উদ্বোধন করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ সেখানে উৎপাদনই চালু হয়নি! কারণ হিসেবে সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার অলক দত্তরায়ের ব্যাখ্যা, “কোল হ্যান্ডলিং ও অ্যাশ হ্যান্ডলিং প্লান্টের পরিকাঠামো তৈরি শেষ না-হওয়ায় তৃতীয়
ইউনিটে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না।’’
পরিকাঠামো শিগগিরই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন জিএম। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, উদ্বোধন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পরিকাঠামো কেন ঠিকঠাক গড়ে উঠল না?
এখানেই উঠে আসছে জুলুম ও হামলাবাজির একাধিক কাহিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থার অনেকের দাবি, শাসকদলের ঘনিষ্ঠ কিছু দুষ্কৃতীর দাদাগিরিতেই পরিকাঠামোর কাজ পদে পদে বাধা পাচ্ছে। কর্মী-সূত্রের খবর: নানান অছিলায় দুর্বৃত্তেরা ঠিকা-শ্রমিকদের উপরে চড়াও হচ্ছে। পদস্থ কর্তাদেরও রেয়াত করছে না। অভিযোগ, গত এক বছরে হামলার শিকার হয়েছেন তৃতীয় ইউনিটে কর্মরত তিন প্রজেক্ট ম্যানেজার— এস শিবরাজ, এ কে সিংহ এবং সলিল নন্দী। এমনকী, তাঁদের লক্ষ্য করে গুলিও চলেছে বলে অভিযোগ। পুলিশে একাধিক বার নালিশ জানানো হয়েছে। যদিও তেমন সুরাহা কিছু হয়নি। ‘‘রুলিং পার্টির লোকজন পিছনে থাকলে পুলিশের সাধ্যি কী কারও টিকি ছোঁয়!’’— কটাক্ষ করছেন কর্মীদের কেউ কেউ।
শেষমেশ অবশ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিতরে একটা আলাদা থানা গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। তার যাবতীয় বন্দোবস্থ করে দেবে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম। সংস্থার কর্তাদের আশা, থানা হলে হামলায় লাগাম পড়বে। পুলিশেরও তাই অভিমত। শাসকদলের তরফে কী বলা হচ্ছে?
পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। যেমন সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃণমূল সমর্থিত ঠিকা-শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক মানেন না, এ সবে তৃণমূলের কেউ জড়িত। তবে এমন ঘটনা যে ঘটেছে, তা তিনি অস্বীকার করছেন না। আর সে প্রসঙ্গে ওঁর আঙুল দলের ‘বিক্ষুব্ধ’ অংশের দিকে। “দলের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী বিভিন্ন সময়ে প্লান্টে হামলা চালিয়েছে। কর্তাদের হেনস্থা করেছে। দলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কয়েক জন নেতা তাদের মদত দিয়েছে।’’— বলছেন তিনি। রাজ্জাকের মন্তব্য, ‘‘দলকে সব জানিয়েছি। এখনও সাড়া পাইনি।’’
অন্য দিকে সাগরদিঘি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের তৃণমূল কর্মী সংগঠনের সম্পাদক সমরেন্দ্র পর্বত দায়ী করছেন ঠিকাদার সংস্থাগুলিকে। তাঁর কথায়, “ছাই ফেলা, জল আনা ও কয়লা হ্যান্ডলিং নিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদার কোম্পানিই হরেক বাহানা খাড়া করছে। সময় মতো কাজ শেষ করছে না।’’
গত ১৫ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী সাগরদিঘির তিন নম্বর ইউনিটের উদ্বোধন করেছিলেন। অনুষ্ঠানের পিছনে কয়েক কোটি টাকা খরচও হয়। এখন সংস্থার কর্তারা জানাচ্ছেন, তৃতীয় ইউনিটে কয়লা আনার কনভেয়ার বেল্টই তৈরি হয়নি! নমুনা হিসেবে ক্রেনে করে কয়লা এনে ঘণ্টাখানেক ইউনিট চালু রেখে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যে এপ্রিল ও মে মাসে দু’টো দিন ঠিক করা হয়েছিল। তা বিফলে গিয়েছে।
রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের খবর: পরিকল্পনা মোতাবেক সাগরদিঘির তৃতীয় ইউনিট ২০১৪-র নভেম্বরে ও চতুর্থ ইউনিট ২০১৫-র ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ইতিমধ্যে অনেকটা পিছিয়ে আসতে হয়েছে। সাগরদিঘিতে আপাতত কাজ করছে তিনশো মেগাওয়াটের দু’টো ইউনিট— ২০০৮ সালে চালু হওয়া। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে ধরে নিয়ে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার ওখানে পাঁচশো মেগাওয়াটের দু’টো নতুন ইউনিটের পরিকল্পনা করে।
২০১১-য় প্রকল্পের শিলান্যাস হয়। তার পরে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও তৃতীয় ইউনিট থেকে রাজ্যের গ্রিডে এক ইউনিটও বিদ্যুৎ ঢোকেনি। নিগম কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, সমস্যা মিটিয়ে চলতি মাসেই তৃতীয় ইউনিট পুরোদমে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে দেবে।
শুনে বিদ্যুৎ দফতরের একাংশই সংশয়ে। ‘‘না-আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’— বলছেন তাঁদের অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy