সাজিদ
সাজিদ ওরফে রহমতুল্লা ওরফে বুরহান শেখ, নাকি মাসুদ রানা ওরফে মাসুম?
ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে ফরাজীকান্দা গ্রামটি খুঁজে পাওয়া গেল ঠিকই, কিন্তু সাজিদ বা তার পরিবারের হদিশ মিলল না।
পাড়ার দোকান থেকে মহল্লার অধিবাসী, নানা পেশার মানুষ তাঁরা। কিন্তু সাজিদ বা রহমতুল্লার নাম কেউ শোনেনি। বুরহান শেখ নামে এক জন গ্রামে থাকত বটে, কিন্তু সে তো জঙ্গি নয়, মালয়েশিয়ার কোনও সংস্থায় চাকরি করতে চলে গিয়েছে!
প্রৌঢ় শহিদুল্লাহ অনেক চিন্তা করে বললেন, দুই জঙ্গির সন্ধানে পুলিশ দু’বার ফরাজীকান্দায় এসেছিল বটে, কিন্তু তাদের কারও নামই সাজিদ বা রহমতুল্লা নয়। এক জনের মাসুদ, অন্য জনের জুম্মন আমিন। দু’জনের দুই পরিবারই গ্রামে ভাড়া থাকত।
স্থানীয় বন্দর থানার পুলিশও সাজিদ নামে কোনও জঙ্গির বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারল না।
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ঢাকায় ফেরার কথা ভাবতে হচ্ছে যখন, তখন গ্রামের বাইরে একটি চায়ের দোকানে মিলল পিলে চমকে ওঠার মতো তথ্য।
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক যুবক আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানালেন—ভারতে যে সাজিদ ধরা পড়েছে, সে এই ফরাজীকান্দারই ছেলে মাসুম। তার এক ভাই মনা ওই গ্রামের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি।
ফের ফরাজীকান্দায় ঢোকা মনার খোঁজে। বিকেল চারটে নাগাদ বছর ৪৫-এর মনা তখন নিজের কারখানায় কাজ করছিলেন। পরিচয় দিতে বসতে বললেন। জানালেন তার জঙ্গি ভাইয়ের নাম সাজিদ নয় মাসুদ রানা, ডাক নাম মাসুম। তবে অনেক নামে সে অনেক জায়গায় পরিচিত। এর কোনওটাই তার পরিবারের দেওয়া নাম নয়। বাবা মারা যাওয়ার পরে ৪ ভাই, ৪ বোনের সংসারে সবার ছোট মাসুমকে ঢাকার একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। পরিবার চেয়েছিল, সুশিক্ষা পেয়ে সে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনের পাল্লায় পড়ে সে বিপথে চলে যায়। ভাই মনা জানান, “বছর আট-দশ পরিবারের সঙ্গে মাসুমের সম্পর্ক নেই। শুনেছিলাম সে আফগানিস্তানে চলে গিয়েছে। বেঁচে আছে কিনা তা-ও জানতাম না। এখন শুনছি, সে ভারতে ধরা পড়েছে।”
মনা জানালেন, মাসুদ ভারতে নিজের নাম বুরহান শেখ বলেছে বটে, কিন্তু বুরহান শেখ আসলে তাঁদের মেজো ভাইয়ের নাম। তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। বড় ভাই কাইয়ুম ঢাকায় বাবুর্চির কাজ করেন। সেজ ভাই ঢাকায় কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। বাবা স্বর্গীয় সিদ্দিকি মিয়াঁ এলাকায় পচা মিয়াঁ নামে পরিচিত। ওই জন্যই আসল নাম বলায় কেউ তাঁকে চেনেননি।
এ বার ফের মাসুদ রানার খোঁজে চলল তল্লাশি। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ দিব্যি চেনে মাসুদকে। তার পরিচিতি বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসেবে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমান ও তার ভাই আতাউর রহমান সানির ঘনিষ্ঠ এই জঙ্গি বাংলাদেশের নানা জেলায় সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করত। শায়খ ও দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা আতাউর ধরার পড়ার পরে ফাঁসিতে প্রাণ হারিয়েছে। তার পরে জেএমবি-র সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে মাসুদ রানাই উঠে আসে। ভেঙে যাওয়া সংগঠনকে গড়ে তুলতে গোটা দেশ চষে বেড়াত সে। কখনও থাকত রাজশাহিতে, কখনও তার পাশের জেলা বগুড়া বা চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
পুলিশ ও আইবি সূত্রে জানা গিয়েছে, জেএমবি সংগঠন গড়ে ওঠার প্রথম দিন থেকেই মাসুদ রানা তার কেন্দ্রীয় কমিটি মজলিস-এ-সুরার সদস্য। বাংলাদেশে ‘পশ্চিমি’ গণতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে শরিয়তি শাসনব্যবস্থা কায়েমই জেএমবি-র লক্ষ্য। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাতে ইসলামির সরকারের আমলে তরতর করে বেড়ে ওঠে জেএমবি-র সংগঠন। বাংলা ভাই ছিল দলের সশস্ত্র শাখার কম্যান্ডার। আফগানিস্তানে তালিবানের হয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশ কিছু যোদ্ধাও এই সংগঠনে নাম লেখায়।
বিএনপি-জামাত আমলের কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠন মজবুত হলেও বাংলাদেশ সরকার জেএমবি-র অস্তিত্ব নেই বলে বার বার ঘোষণা করে। সে সময়েই দেশের সর্বত্র নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ২০০৫ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সব ক’টিতে একযোগে বোমা ফাটানোর কর্মসূচি নেয় জেএমবি। ঠিক হয়, কম মাত্রার বোমা ফাটানো হবে, যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। এতে প্রধান ভূমিকা ছিল মাসুদ রানার। কিন্তু ২০০৭-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতা দখলের পর জেএমবি-র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালায়। শায়খ আব্দুর রহমান, আতাউর রহমান সানি ও বাংলা ভাইয়ের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে দলের বহু চাঁই ও সাধারণ কর্মী ধরা পড়ে। মাসুদও গ্রেফতার হয় বগুড়া থেকে। তার পরে শেখ হাসিনা সরকার ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে।
পুলিশ সূত্রের মতে, জেলে বসেই জেএমবি-র নেতারা দেশের বাইরে তাদের সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গকেই তারা সুবিধাজনক অবস্থান হিসেবে বেছে নেয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজশাহি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে মুর্শিদাবাদের লালগোলায় মকিমনগর মাদ্রাসায় ডেরা বাঁধে মাসুদ রানা। পশ্চিমবঙ্গে সংগঠন গড়ে তোলার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় তার উপরে। পদ্মার বুকে আষাঢ়িয়াদহের চরেও কয়েকটি ঘাঁটি বানায় মাসুদ। সেখানে মাঝে মাঝেই এসে থাকত সে। অস্ত্র-বিস্ফোরক, মাদক, জাল নোটের চোরাচালানের জাল নিয়ন্ত্রণ করত। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা বলছেন, এ কাজে তার অন্যতম সহযোগী ছিল স্থানীয় এক জামাত নেতা, নাম কওসর জামাতি।
ফরাজীকান্দা নিশ্চিত কলকাতায় ধৃত সাজিদ আদতে তাদের গ্রামের মাসুদ রানাই, যার ডাক নাম মাসুম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy