মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করতে শুরু করা বিচারক তাঁকে থামিয়ে দিলেন। খাগড়াগড়-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্তের আইনজীবী অবশ্য তাতে দমে যাননি। বরং শুক্রবার আদালত পর্বের শেষে তিনিও জানিয়ে দিলেন, পরবর্তী সময়ে মক্কেলের জামিন চাওয়ার জন্য তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকেই হাতিয়ার করতে চান। গত ২২ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বক্তৃতাই তাঁর ভরসা, যেখানে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র থাকার সম্ভাবনা ব্যক্ত হয়েছে।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত সাত জনকে এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারক মহম্মদ মুমতাজ খানের এজলাসে তোলা হয়েছিল। জিয়াউলের জামিনের আবেদন জানাতে উঠে তাঁর কৌঁসুলি রামদুলাল মান্না বলতে শুরু করেন, “মুখ্যমন্ত্রীই বলেছেন.....।” বিচারক তাঁকে এর বেশি এগোতে দেননি। রামদুলালবাবুকে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দিয়ে বিচারক বলেন, “এটা আদালত। রাজনৈতিক বক্তৃতার জায়গা নয়। নথির বাইরে কোনও কথা আদালতে জানাবেন না।”
মক্কেলের জামিন চাইতে গিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কোন উক্তিকে হাতিয়ার করতে চেয়েছিলেন?
আদালতের বাইরে এই প্রশ্নের জবাবে রামদুলালবাবুর ব্যাখ্যা, “এই তো ক’দিন আগে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রকাশ্য সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বললেন, কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করে গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে দিয়ে খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে! মুখ্যমন্ত্রী কথাটা
ফিরিয়েও নেননি! আমি সেটাই আদালতকে বলতে গিয়েছিলাম।” তাঁর যুক্তি, স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন দায়িত্ব নিয়ে এমন তথ্য দিচ্ছেন, তখন বোঝাই যাচ্ছে, জিয়াউলের মতো নির্বিবাদী শিক্ষককে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। “আজ পারলাম না। তবে পরে সুযোগ পেলে আমি আবার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরেই জিয়াউলের জামিন চাইব।” এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন রামদুলালবাবু।
কলকাতার নগর দায়রা আদালতে (বাঁ দিক থেকে) হাসেম মোল্লা, আব্দুল হাকিম, খালিদ মহম্মদ,
জিয়াউল হক, রাজিয়া বিবি এবং আলিমা বিবি। শুক্রবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
মুখ্যমন্ত্রী সে দিন ঠিক কী বলেছিলেন?
গত ২২ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে আয়োজিত তৃণমূলের ওই কর্মিসভায় মমতা খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে সন্দেহের আঙুল তোলেন। বক্তৃতায় বলেন, “খাগড়াগড়ে হয়তো কেন্দ্রই ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং, ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা)-কে দিয়ে বোমা রাখিয়েছে! মনে রাখবেন, আমি ২৩ বছর কেন্দ্রে ছিলাম। কে কী ভাবে ষড়যন্ত্র করে, সব জানি।” খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এ হেন মন্তব্য ঘিরে শোরগোল পড়ে যায়। খাগড়াগড়-কাণ্ডের জেরে এনআইএ যাদের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) প্রয়োগ ছাড়াও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ ঘোষণার চেষ্টার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে, তারা মমতার মন্তব্যের ফায়দা লুটতে সচেষ্ট হবে বলে তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আইনজ্ঞদের অনেকে।
বাস্তব এখন তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ দিন জিয়াউলের কৌঁসুলির কথা শুনে কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যা ভয় করছিলাম, সেটাই হতে চলেছে! মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে হাতিয়ার করে জামিন পেতে চাইছে খাগড়াগড়ের অভিযুক্তেরা।” সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, “মুখ্যমন্ত্রীর উক্তিকে ঢাল হিসেবে খাড়া করে অভিযুক্তেরা তো আদালতে সওয়াল করবেই, উপরন্তু দেশের শত্রু যারা, তারাও একে অস্ত্র করবে। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এ জাতীয় কথাবার্তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।” কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ মনে করেন, এ দিন অভিযুক্তের কৌঁসুলি কোর্টকে যা বলতে চেয়েছিলেন, তা তাঁকে বলতে দেওয়া উচিত ছিল। “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন খাগড়াগড় বিস্ফোরণে ‘র’-এর হাত রয়েছে, তখন সেই যুক্তি দেখিয়ে অভিযুক্ত নিজেকে নির্দোষ দাবি করতেই পারেন।” মন্তব্য অরুণাভবাবুর। হাইকোর্টের আর এক আইনজীবীর কথায় “অন্যান্য অভিযুক্তের কৌঁসুলিও যে এই পথে হাঁটবেন না, তার গ্যারান্টি কী? নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, এমনকী সুপ্রিম কোর্টেও জামিনের হাতিয়ার হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে তুলে ধরা হতে পারে।”
বিচারকের সামনে মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করতে না-পারলেও জিয়াউলের কৌঁসুলি অবশ্য এ দিন মক্কেলের জামিনের আবেদন করেছিলেন। সে জন্য তিনি সাজিয়েছিলেন অন্য যুক্তি। রামদুলালবাবু আদালতকে জানান, জিয়াউল বিএড পরীক্ষার্থী। আগামী ৪ জানুয়ারি তাঁর বিএড পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, তিনি অ্যাডমিট কার্ডও পেয়ে গিয়েছেন। ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়ে তিনি যাতে পরীক্ষায় বসতে পারেন, তা মাথায় রেখে জামিন মঞ্জুর হোক। রামদুলালবাবু সওয়ালে এ-ও বলেন, “সন্তানকে নিয়ে ওঁর স্ত্রী কার্যত গৃহহীন অবস্থায় রয়েছেন। এনআইএ জিয়াউলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দিয়েছে। ফলে তাঁর স্ত্রী নিজের ও সন্তানের খাওয়ার টাকাও জোগাড় করতে পারছেন না।” অন্য দিকে, জামিনের বিরোধিতা করে এনআইএ-র কৌঁসুলি শ্যামল ঘোষ সওয়ালে দাবি করেন, খাগড়াগড়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। বিস্ফোরণের মূল পান্ডা শেখ ইউনুস, শেখ বরুণ ও শেখ রিয়াজুলের সঙ্গে জিয়াউলের একাধিক বার টেলিফোনে যোগাযোগ হয়েছে। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তাই অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া উচিত হবে না।
দু’পক্ষের সওয়াল শুনে জামিনের আর্জি খারিজ করে দেন বিচারক। জিয়াউল-সহ সাত অভিযুক্তের আগামী ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy