দেশে প্রথম রূপান্তরকামীদের জন্য পৃথক উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করে এক বছর আগে নজির গড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু দেশে প্রথম সরকারি হাসপাতালে রূপান্তরকামীদের জন্য পৃথক বহির্বিভাগ এবং নিখরচায় পূর্ণাঙ্গ লিঙ্গ পরিবর্তন ক্লিনিক খোলার ঘোষণা করেও তা রক্ষা করতে পারল না এ রাজ্য। কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিকটি যে আপাতত চালু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজার উদ্যোগে গত বছর তৈরি হয় রূপান্তরকামীদের উন্নয়ন পর্ষদ। শশী এখন স্বাস্থ্য দফতরেরও দায়িত্বে। তা হলে আর জি করে কেন ওই কেন্দ্রটি চালু করা যাচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলেছেন রূপান্তরকামীদেরই একটা বড় অংশ।
এক বছর আগে ওই পর্ষদ গড়ার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এ রাজ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি রূপান্তরকামী মানুষ রয়েছেন। তাঁদের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। সরকারি তরফে কী ভাবে তা দেওয়া যায়, তা ভাবা হচ্ছে। সম্পূর্ণ নিখরচায় অস্ত্রোপচারে লিঙ্গ পরিবর্তন করার পরিষেবা দেওয়ার কথাও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
এই মুহূর্তে রাজ্যে সরকারি পরিকাঠামোয় ‘সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি’ বা লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার হয় শুধুমাত্র এসএসকেএম হাসপাতালে। কিন্তু তা একেবারেই হাতে গোনা। সেখানে এ জন্য কোনও পৃথক বিভাগ নেই। নেই পৃথক ক্লিনিক বা আউটডোরও। মনোরোগ, এন্ডোক্রিনোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি এবং ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের প্রধান, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক অরিন্দম সরকার জানান, গোটা প্রক্রিয়ায় পাঁচটি ধাপ। সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং, এন্ডোক্রিন কাউন্সেলিং, লেসার হেয়ার রিমুভাল, ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট এবং সব শেষে জেন্ডার সার্জারি বা লিঙ্গ পরিবর্তন। সব মিলিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় লাগে। তিনি বলেন, ‘‘এসএসকেএমে এখনও পর্যন্ত চার জনের এই অস্ত্রোপচার হয়েছে। অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকে।’’
লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরুর আগেও বছর দেড়েকের প্রস্তুতি প্রয়োজন। পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের আগে আইনি অনুমোদনও নিতে হয়। হাসপাতালের বোর্ডকেও সব দিক খতিয়ে দেখে ছাড়পত্র দিতে হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ‘সেক্সুয়াল ডিজঅর্ডারে’ ভুগছেন। এ সবের পরে শুরু হয় মূল প্রক্রিয়া। এসএসকেএমের চিকিৎসেকরা জানিয়েছেন, তাঁদের হাসপাতালে এই ধরনের অস্ত্রোপচারের হদিস নিতে আসেন বহু রূপান্তরকামী। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগেরই বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘পৃথক কোনও বহির্বিভাগ থাকলে এঁরা সরাসরি সেখানে যেতে পারতেন। আমাদের হাসপাতালে এই বিপুল চাপের মধ্যে এখনই সেটা করা সম্ভব নয়। তবে সব কিছু ঘোষণার পরেও আর জি কর কেন পিছিয়ে গেল জানি না।’’
আর জি করের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রূপনারায়ণ ভট্টাচার্য জানান, তাঁরা সরকারি অনুমোদন পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ক্লিনিকটি এখনই চালু করা সম্ভব নয়। কেন? তাঁর জবাব, ‘‘এখনও বেশ কিছু ব্যাপার ঠিক করা বাকি। প্রোটোকল তৈরি করতে হবে। নিজস্ব ক্লিনিক গড়তে বলে বিদেশি প্রোটোকল মেনে কাজ করা যাবে না। তা ছাড়া ‘টার্গেট পেশেন্ট’ কারা হবে, সেটা স্পষ্ট করা দরকার। মনস্তত্ত্ব এবং আইনের দিকগুলি স্পষ্ট করার জন্য রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এর সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিষয়টি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। কবে হবে, কিছুই বলা যাচ্ছে না।’’
উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারপার্সন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লিভার বা কিডনি প্রতিস্থাপন কিংবা লিঙ্গ পরিবর্তন— সবই তো বড় এবং জটিল অস্ত্রোপচার। কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রে সেই রোগীর চারপাশে অনেকে থাকেন, যাঁরা সাহায্য করতে চান। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিন্তু মানুষটা একা। অনেক বেশি মনের জোর, অনেক বেশি ধৈর্য্য নিয়ে তাকে পথ চলতে হয়। তাই পৃথক পরিকাঠামো থাকাটা জরুরি।’’
স্বাস্থ্য ভবনের একটি সূত্রের খবর, এই ধরনের একটি ক্লিনিক চালাতে গেলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যে সমন্বয় এবং যে সংখ্যক চিকিৎসক থাকা দরকার, এই মুহূর্তে আর জি করে তা নেই। সেই কারণেই বিভাগটি চালু করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা অবশ্য দাবি করেছেন, ক্লিনিক গড়ার কাজ আপাতত স্থগিত থাকছে, এমন কোনও খবর তাঁর কাছে নেই। তিনি জানান, সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারি পরিকাঠামোয় রূপান্তরকামীদের অস্ত্রোপচারের জন্য পৃথক পূর্ণাঙ্গ ক্লিনিক এ রাজ্যেই প্রথম চালু করে ফের দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy