Advertisement
E-Paper

তারাপীঠ থেকে জলপাইগুড়ি পালানোর তালে ছিল শ্যামল

সোমবার ভোর পাঁচটা। তারাপীঠের এক লজের রিসেপশনে ঢুকল ওরা তিন জন। ছোটখাটো চেহারার এক যুবকের মাথা পুরো নেড়া। গোঁফ-দাড়িও নিপুণ ভাবে কামানো। তিন জনকে দেখে লজের ম্যানেজারের রাজু রায়ের আপাতদৃষ্টিতে সন্দেহ হয়নি। তারাপীঠে সকাল থেকে রাতহাজার হাজার লোক রোজ আসছে। আর হোটেল-লজের ঘর ভাড়া নিচ্ছে। তিন জনের মধ্যে এক জন হোটেলের রেজিস্টারে নিজের নাম-ঠিকানা লিখল।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৯
ধৃত রতন দাস ওরফে তোতাকে নিয়ে তারাপীঠের লজে তদন্তে পুলিশ। অনির্বাণ সেনের তোলা ছবি।

ধৃত রতন দাস ওরফে তোতাকে নিয়ে তারাপীঠের লজে তদন্তে পুলিশ। অনির্বাণ সেনের তোলা ছবি।

সোমবার ভোর পাঁচটা। তারাপীঠের এক লজের রিসেপশনে ঢুকল ওরা তিন জন। ছোটখাটো চেহারার এক যুবকের মাথা পুরো নেড়া। গোঁফ-দাড়িও নিপুণ ভাবে কামানো।

তিন জনকে দেখে লজের ম্যানেজারের রাজু রায়ের আপাতদৃষ্টিতে সন্দেহ হয়নি। তারাপীঠে সকাল থেকে রাতহাজার হাজার লোক রোজ আসছে। আর হোটেল-লজের ঘর ভাড়া নিচ্ছে। তিন জনের মধ্যে এক জন হোটেলের রেজিস্টারে নিজের নাম-ঠিকানা লিখল। জমা রাখল নিজের সচিত্র ভোটার কার্ডের ফোটোকপি। একটি এসি রুম পছন্দ হয় ওই তিন জনের। ম্যানেজারকে তারা বলে, মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ লজ ছেড়ে দেবে তারা। রামপুরহাট স্টেশন থেকে তারা গৌড় এক্সপ্রেস ধরবে। কিন্তু, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদই ঘর ছেড়ে দেয় ওই তিন জন।

এই অবধি সবই ঠিক ছিল। অন্তত রাজু রায়ের কাছে।

আসলে কিছুই ঠিক ছিল না!

মঙ্গলবার রাতে গৌড় এক্সপ্রেসই ধরতে গিয়েছিল ওই তিন জন। কিন্তু, ট্রেন ধরার আগেই দু’জনকে পাকড়াও করে স্টেশনে ওত পেতে বসে থাকা পুলিশ। তাদেরই এক জন, বামনগাছির কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার। সে কোথায়, এই প্রশ্নে যখন গোটা রাজ্য তোলপাড়, তখন মাথার চুল ও সাধের দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে শ্যামল সোম ও মঙ্গলবার দিনভর ডেরা বেঁধেছিল তারাপীঠের ওই লজে! পুলিশের জালে শ্যামলের সঙ্গে ধরা পড়ে রতন দাস ওরফে তোতা। তবে, লজের রেজিস্টারে নিজের নাম লিখে ভোটার কার্ড জমা রেখেছিল শ্যামলের যে সঙ্গী, তাকে পুলিশ ধরতে পারেনি। বিপদ বুঝে সে গায়েব হয়ে যায়।

শ্যামলকে জেরা করে পুলিশ জেনেছে, জলপাইগুড়িতে এক পরিচিতের বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিল তারা। বুধবার রাত ২টো নাগাদ মধ্যমগ্রাম থানার এসআই সমিত মণ্ডল রতনকে সঙ্গে নিয়ে তারাপীঠের ওই লজে তদন্তে যান। ডেকে পাঠানো হয় ম্যানেজারকে। তখনও তিনি জানতেন না, সোমবার ভোরে ওই তিন জনকে ঘরভাড়া দিয়ে কত বড় ভুল করে ফেলেছেন। বামনগাছির ঘটনা সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে তিনি ভাল করেই জানেন। রতনকে দেখেই শনাক্ত করেন লজ ম্যানেজার। পুলিশ লজের রেজিস্টারটি বাজেয়াপ্ত করে। রেজিস্টার পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে ভুয়ো নামে ঘর ভাড়া নিয়েছিল শ্যামল আর রতন। রেজিস্টারে ওই দু’জনের নাম লেখা হয়েছিল তারক কুণ্ডু ও কার্তিক মণ্ডল। দু’জনের কারও ঠিকানাই দেওয়া হয়নি। ওই দু’জনের সঙ্গে তৃতীয় নামটি ছিল শিশির মুখোপাধ্যায়ের। সঙ্গে কলকাতার ঠিকানা (৫৩/৬ চাউলপট্টি রোড, বেলেঘাটা)। শিশিরেরই ভোটার-কার্ডের প্রতিলিপি জমা দিয়ে লজে ঘরভাড়া নিয়েছিল শ্যামলরা।

তারাপীঠের মুণ্ডমালিনীতলা যাওয়ার রাস্তা থেকে সামান্য দূরে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির পিছনে দোতলা ওই লজ। বুধবার রাতে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, তখনও পুলিশি তদন্ত চলছে। সব মিলিয়ে ১৬টি ঘর রয়েছে লজটিতে। ম্যানেজার রাজু রায় জানান, প্রথমে ১০৬ নম্বর এসি ঘরটি পছন্দ হলেও পরে শ্যামলরা একতলার ১০২ নম্বর ঘরটি ভাড়া নেয়। পুলিশ ওই ঘরটি খুলে ভিতরে তল্লাশি শুরু করে। পুলিশকে রাজু জানান, শিশির মাঝেমধ্যে বাইরে বের হলেও নেড়া মাথার যুবক (শ্যামল) আর অন্য জন ঘরেই থাকত। তাদের জন্য বাইরে থেকে খাবার এনে দিত শিশির। রাজুবাবুর দাবি, “শ্যামলরা প্রথমে অন্য একটি লজে ঘরভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেখানে দরদাম করে না পোষানোয় আমাদের লজে আসে। লজ ছাড়ার আগে ঘরভাড়া বাবদ ৬০০ টাকা মিটিয়ে দেয়।” প্রথমে লজ ছেড়ে যায় শ্যামল। কিছু পরে শিশির ও রতন।

পুলিশের দাবি, জেরার মুখে শ্যামলরা জানিয়েছে, শিশির মুখোপাধ্যায় নামে ওই ব্যক্তি আগে বামনগাছিতে থাকত। এলাকায় শঙ্কু-পুরুত নামেই সবাই তাকে চিনত। সেই সূত্রে শ্যামলের সঙ্গে শিশিরের পরিচয়। সৌরভ খুনের পরে এলাকার পরিস্থিতি দেখে শ্যামল শিশিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। গত রবিবার রাতে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে শিশির, শ্যামল ও রতন সোমবার ভোরে তারাপীঠে পৌঁছয়। মঙ্গলবার রাতে রামপুরহাট স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে জলপাইগুড়িতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে শ্যামলকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল শিশির। শেষরক্ষা অবশ্য হয়নি।

শ্যামলদের ধরা পড়ার পরে তারাপীঠের নানা হোটেল ও লজে সঠিক কাগজপত্র জমা না রেখেই ঘরভাড়া দেওয়ার পুরনো অভিযোগ ফের সামনে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে এক জনের পরিচয়পত্র দেখেই অন্য দু’জনকেও ঘরভাড়া দেওয়া হল? ওই লজের ম্যানেজারের দাবি, শ্যামলরা নিজেদের একই পরিবারের সদস্য বলে দাবি করেছিল। আর সে জন্যই কেবল এক জনের পরিচয়পত্র দেখেই তিনি ওই তিন জনকে ঘরভাড়া দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে লজের অন্যতম মালিক আনন্দ মণ্ডল বলেন, “আমরা বুঝতে পারিনি, এই ভাবে এক জনের পরিচয়পত্র দেখে তিন জনকে একই ঘরে থাকতে দেওয়াটা কত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে আমরা আরও সতর্ক হব।”

বীরভূম জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, তারাপীঠের অনেক হোটেল-লজের মালিকই ঘরভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মানেন না। আর সেই সুযোগে বিভিন্ন সময় অপরাধীরা সহজেই ঘরভাড়া নিয়ে পুলিশের নাগালের বাইরে পুণ্যার্থী সেজে লুকিয়ে থাকে সেখানে। এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও বলেন, “প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেকের পরিচয়পত্র দেখে ঘরভাড়া দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমস্ত হোটেল ও লজকে। তার পরেও যাঁরা নিয়ম মানছেন না বলে অভিযোগ ওঠে, তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিই। এ ক্ষেত্রে এখনও অভিযোগ পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তারাপীঠ লজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবীপ্রসাদ মণ্ডল অবশ্য বলছেন, “খুব তাড়াতাড়িই বৈঠক বসে এ ব্যাপারে আরও একবার সবাইকে সতর্ক করব।”

apurbachattapadhyay tarapith shyamal escapeplan jalpaiguri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy