তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হুইসল দিয়ে যখন এল ইঞ্জিনটা, ভয়ে সব এদিক ওদিক ছুটে পালাল। গাঁয়ে গাঁয়ে লোক পাঠানো হল ভয় ভাঙাতে।
খড়্গপুরে প্রথম রেলগাড়ি ঢোকার পরে স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া। আস্ত ট্রেন নয়। একটা ইঞ্জিন এসেছিল। খবর পেয়ে লোকজন জড়োও হয়েছিল। কিন্তু সেটা কাছে আসতেই ছুট। রেল শহর হিসেবে পরিচিত খড়্গপুর। কিন্তু রেলগাড়িকে মানতে বহু দিন লেগেছিল খড়্গপুরের আদি বাসিন্দাদের।
বন কেটে বসত হয়। খড়্গপুরে তা-ই হয়েছিল। কিন্তু বন কাটার মূলে ছিল রেল লাইন পাতা এবং জংশন স্টেশন তৈরি। আজকের খড়্গপুর দেখে এর জঙ্গুলে অতীত অনুমান সম্ভব নয়। ইতিহাস বলছে, উনিশ শতকের শেষের দিকেও খড়্গপুর ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। মানুষের বসতি হাতেগোনা। কলাইকুণ্ডা বিমান ঘাঁটি, আইআইটি এলাকা, ইন্দা, সবই জঙ্গলে ভরা। জঙ্গল পথে ছিল বিপদের আশঙ্কাও। খড়্গপুরের পরিবর্তন শুরু ১৮৮৭ সালে। তৈরি হল বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানি (বিএনআর)। ব্রিটিশ শাসকেরা তৎকালীন বোম্বাইকে রেল পথে কলকাতার সঙ্গে জুড়তে চাইলেন। নজর পড়ল খড়্গপুরের দিকে।
খড়্গপুর নাকি হেরে যাচ্ছিল মেদিনীপুরের কাছে। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছিল, মেদিনীপুরে তৈরি হবে জংশন স্টেশন। কিন্তু বিএনআর হিসেব করে দেখে, মেদিনীপুরের থেকে খড়্গপুরে জংশন স্টেশন করলে লাভ বেশি। খড়্গপুরের জমি পাথুরে। এখানে ঘর বাড়ি তৈরি করতে কম খরচ পড়বে। তাছাড়া জঙ্গলের গাছগুলোও কাজে আসবে। শ্রমিক এবং অফিসারদের ঘর তৈরিতে তো লাগবেই উপরন্তু রেল লাইনের জন্যও কাঠ মিলবে। আর এখানে রেল লাইন পাতলে কাঁসাই নদীতে ডবল লাইনের সেতু তৈরির খরচ বেঁচে যাবে।
হিসেবনিকেশ শেষে ১৯০১ সালে তৈরি হল খড়্গপুর জংশন স্টেশন। ১৯০৪ সাল নাগাদ রেল কারখানা চালু হল। কিন্তু তখনও খড়্গপুর রেল এলাকার জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মতো। এই সংখ্যা আবার রেল লাইন চালুর আগের থেকে যথেষ্ট বেশি। এখন তো খড়্গপুর দেশের ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্যতম। এই রেল শহরকে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ও বলা হয়। এলাকাটির লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ‘মিনি ইন্ডিয়া’ হয়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে রেলের অবদান।
শুরুর দিকে রেল এবং রেলের সাহেবসুবোদের মানুষ ভাল ভাবে নেননি। রেলের জন্য এলাকার আদি বাসিন্দারা অনেকে জমি হারিয়েছিলেন। জঙ্গলের অধিকার হারিয়েছিলেন। তার ওপর ছিল কুসংস্কার। ইঞ্জিন দেখে ছুটে পালানোর ভয় ছিল রেলগাড়ি চালু হওয়ার অনেকদিন পর পর্যন্ত। অনেকে রেলগাড়ি চড়তে চাইতেন না। তাঁদের ধারণা ছিল, সেতুর ওপর দিয়ে গেলে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে রেলগাড়ি নদীতে পড়বে। ছিল জাত যাওয়ার ভয়। রেলের কামরায় তো বর্ণভেদ নেই। সকলেরই একসঙ্গে যাত্রা। লোকে এলাকার রোগজ্বালার জন্যও রেলকে দায়ী করতে শুরু করেছিল। একবার এলাকায় কলেরা ছড়িয়ে পড়ল। মৃত্যু হল। দোষ পড়ল রেলগাড়ির ওপরে।
অবশ্য কুসংস্কারের ক্ষেত্রে রেলের সাহেবসুবোরাও কম যেতেন না। কোনও বড় কাজে হাত দেওয়ার আগে কোম্পানির লোকেরা নাকি পাঁজিপুথি দেখে দিনক্ষণ ঠিক করতেন। সে জন্য পণ্ডিতও নিয়োগ করা হতো। তখন এই এলাকায় সবে মাত্র রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে। রাস্তার মাঝে পড়ল পাহাড়। সেটা ডিনামাইট দিয়ে ওড়াতে হবে। পণ্ডিত দিনক্ষণ দেখে দিলেন।
তবে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকেও দূরত্ব তৈরি করা হয়েছিল। রেল সংস্থায় স্থানীয় লোক খুব একটা নেওয়া হতো না। মেদিনীপুর ব্রিটিশ বিরোধিতার অন্যতম ঘাঁটি। ফলে একটা অবিশ্বাস ছিল। কিন্তু একটা সময়ে শাসক এবং প্রজা উভয়েই বুঝতে পেরেছিল, রেল থেকে দূরে থাকা যাবে না। শাসকেরা বাসিন্দাদের কাছে টানার চেষ্টা করল। বিএনআর বিনা পয়সায় রেলে চাপার সুযোগ দিত। রেলে চাপলে কম্বল পেতেন যাত্রীরা। পরে স্থানীয় যুবকদের চাকরি দেওয়া শুরু হল। আস্তে আস্তে ভয় কেটে গেল। তখন আবার রেলে চড়ার জন্য হুড়োহুড়ি।
ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে। রেল সংস্থা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কর্মী আনতে শুরু করে দিয়েছে। রেল লাইন পাতা থেকে রেল কারখানার উৎপাদনে প্রচুর লোকবল দরকার। তার আগে জঙ্গলের গাছ কাটা, যন্ত্রপাতি আনার জন্যও প্রয়োজন ছিল কর্মীর। বিএনআর সস্তার শ্রমিক খুঁজত। কাজে লাগানো হত ঠিকাদারদের। তারা উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মাদ্রাজ, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শ্রমিক জোগাড় করত। ওই অঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। মানুষ অসহায়। বেঁচে থাকার তাগিদে পরিবার নিয়ে চলে আসতেন। একসময় খড়্গপুরই বিএনআর-এর লোকো, ক্যারেজ এবং ওয়াগান বিভাগের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এসবের জন্য আরও কর্মীর দরকার হয়। বসত বাড়তে থাকে। খড়্গপুর বাড়তে থাকে। জঙ্গল হয়ে উঠতে থাকে জমজমাট।
১৯১১ সালের মধ্যে খড়্গপুর হয়ে ওঠে অন্যতম রেল শহর। পরে একে একে গড়ে উঠল পুরসভা, আইআইটি। রেলের এলাকা এবং পুরসভা এলাকা কিন্তু একসময়ে আলাদা অঞ্চল ছিল। ১৯৪১ সালে দু’টো এলাকা এক করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলাইকুণ্ডার জঙ্গল এলাকায় তৈরি হল বিমানঘাঁটি। সেনারা এলেন। যুদ্ধের সময়েই অহল্যাবাঈ রোড সম্প্রসারিত করে তৈরি হল ‘ওডিশা ট্রাঙ্ক রোড’। বাংলা-ওডিশা যোগাযোগ বাড়ায় খড়্গপুর মেদিনীপুর শহরের অন্যতম বাজার হয়ে ওঠে। আরও জমজমাট হয় এলাকা।
ততদিনে স্থানীয় বাসিন্দারা রেলকে আপন করে নিয়েছেন। রেল নিয়ে ছড়া গাঁথা হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা রেলকে পুজো করছেন, ছড়া বলে, ‘রেল রেল রেল, তোমার পায়ে দিই তেল’। মেয়েদের মনে হত, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে রেলের পায়ে ব্যথা হয়েছে। তাই পায়ে তেল মালিশ করা দরকার।
খড়্গেশ্বর শিবের নাম অনুসারে নাকি এই এলাকার নাম হয়েছিল খড়্গপুর। সেই নামের ইতিহাসের সঙ্গে রেলের ইতিহাসও বয়ে চলেছে শহরটি। এলাকার পোর্টারখোলি, হাতি গলা পুল রেল পত্তনের সময়ের সাক্ষী। পোর্টারখোলি মানে রেলের কর্মীদের বসত ছিল। আর হাতি গলা পুল? বলা হয়, রেল লাইন পাতার সময়ে রোজ রাতে হাতিরা নাকি লাইন উপড়ে দিত। বুঝতে পেরে রেলের ইঞ্জিনিয়ার সেখানে উঁচু সেতু তৈরি করে দেন। যাতে হাতিরা সহজে নীচ দিয়ে চলে যেতে পারে। হাতি গলে যেত বলে সেতুর এমন নাম।
কৃতজ্ঞতা: নন্দদুলাল রায়চৌধুরী