Advertisement
E-Paper

এক কর্তার ভাঙা ভাড়াবাড়ি, অন্য জনের ঠিকানাই নেই

তাঁর ঠিকানা পিকনিক গার্ডেনের পলেস্তারা খসা ভাড়াবাড়ির এক চিলতে ঘর। বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে কোনও মতে দিন গুজরান করেন। তিনি নিজে এখন বেপাত্তা। তিনি, ‘ত্রিনেত্র কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ডিরেক্টর মনোজ শর্মা। যাঁর সংস্থা রাজ্যের শাসক দল মুখের কথা খসানো মাত্র দেড় কোটি টাকা বের করে দিয়েছিল ভোটের খরচ মেটানোর জন্য।

কাজল গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৮
ত্রিনেত্র-র ডিরেক্টর মনোজ শর্মার বাড়ি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

ত্রিনেত্র-র ডিরেক্টর মনোজ শর্মার বাড়ি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

তাঁর ঠিকানা পিকনিক গার্ডেনের পলেস্তারা খসা ভাড়াবাড়ির এক চিলতে ঘর। বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে কোনও মতে দিন গুজরান করেন। তিনি নিজে এখন বেপাত্তা। তিনি, ‘ত্রিনেত্র কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ডিরেক্টর মনোজ শর্মা। যাঁর সংস্থা রাজ্যের শাসক দল মুখের কথা খসানো মাত্র দেড় কোটি টাকা বের করে দিয়েছিল ভোটের খরচ মেটানোর জন্য।

বিস্ময়ের বাকি ছিল আরও। ত্রিনেত্রর আর এক ডিরেক্টর শশীকান্ত দাসের খোঁজে গিয়ে সেটা পূর্ণ হল। কোম্পানি নিবন্ধকের অফিসে (আরওসি) জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শশীকান্তের ঠিকানা খিদিরপুরের ৪৯/৫/৩এফ কার্ল মার্ক্স সরণি। কিন্তু সেই ঘিঞ্জি গলি চষে ফেলেও ওই নম্বরের কোনও বাড়ির হদিস মিলল না। এমন ঠিকানার খোঁজ দিতে পারল না কলকাতা পুরসভাও!

ত্রিনেত্র সংস্থার অফিসের ছবি কী রকম?

আরওসি-তে থাকা তথ্য অনুযায়ী ১ নম্বর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিটের তিনতলা বাড়ির একটি ঘরে সংস্থার সদর দফতর। কিন্তু দরজায় তালা। দরজার গায়ে সংস্থার নামটুকুও লেখা নেই। এই দরজা শেষ কবে খুলেছিল, বলতে পারেননি ওই বাড়িতে থাকা অন্য সংস্থার কর্মীরাও।

এহেন সংস্থাই ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে তাদের ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দিয়েছিল বলে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হিসেবে দাবি করেছে তৃণমূল। গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর জমা দেওয়া হিসেবে অনুদান বলেই দেখানো হয়েছিল টাকাটা। এ বছর ১০ ফেব্রুয়ারি আবার কমিশনকে চিঠি দিয়ে দলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক জানান, অনুদান নয় টাকাটা পাওয়া গিয়েছে ঋণ হিসেবে। অতএব আগের হিসেব সংশোধন করা হোক। বুধবার সেই চিঠি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবা়জারে। অনুদান না ঋণ, সেই রহস্য কাটাতেই এ দিন আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে যাওয়া হয়েছিল মনোজ ও শশীকান্তের খোঁজে।

পিকনিক গার্ডেনে মনোজের এক চিলতে ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রান্না করছিলেন এক মাঝবয়সী মহিলা। মনোজ আছেন কি না, জিজ্ঞাসা করতেই মুখ ঢাকলেন ঘোমটায়। পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তিনি মনোজের মা, রেশমা শর্মা। মনোজ কোথায়? রেশমা হিন্দিতে বললেন, ‘‘ছেলের সঙ্গে ছ’মাস কোনও যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে জানি না।’’ ছেলে ছ’মাস নিখোঁজ, পুলিশে খবর দিয়েছেন? জবাব মিলল না রেশমার কাছ থেকে। বললেন, ‘‘মনোজের অফিসের এক জন এক বার জানিয়েছিল, ও ভাল আছে।’’ মনোজের মোবাইল নম্বর বা ছবি— কিছুই মিলল না তাঁর কাছ থেকে। মনোজের বাবা কোথায়? রেশমা জানালেন, তিনি রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতে বেরিয়ে গিয়েছেন সাতসকালেই।

ছেলে তো কোটিপতি কোম্পানির ডিরেক্টর। তা হলে বাড়ির এমন হাল কেন? রেশমার জবাব, ‘‘অনেকেই এ সব বলছে। কিন্তু মনোজ তো মধ্য কলকাতায় একটি কোম্পানিতে কাজ করে। ওর আর ওর বাবার অল্প আয়েই কোনও মতে দিন চলে আমাদের।’’ কথা বলতে বলতেই ঘরে উঁকি দিয়ে অবশ্য দেখা গেল, মেঝে
সাদা ঝকঝকে নতুন মার্বেল পাথরে মোড়া। ঘরের সিলিংয়েও সদ্য মেরামতির ছাপ স্পষ্ট। মেঝে মার্বেল করার টাকা এল কোথা থেকে জানতে চাইতেই রেশমা তড়িঘড়ি উত্তর দিলেন‘‘অনেক দিন ধরেই ভাড়া আছি। তাই বাড়িওয়ালা করে দিয়েছে।’’ বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের কাছ থেকে খোঁজ করে জানা গেল, ঘরপিছু ভাড়া মাসে ২৫০ থেকে ১২০০ টাকা। যত পুরনো ভাড়াটে, ভাড়া তত কম। তাঁদের কারও মেঝেই মার্বেল করে দেননি বাড়িওয়ালা। তা হলে মনোজদের প্রতি এমন দাক্ষিণ্য কেন? স্পষ্ট জবাব মিলল না রেশমার কাছ থেকে।

মনোজের বাড়ি তবু খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। শশীকান্তের তো তা-ও মিলল না। কার্ল মার্ক্স সরণির ওই এলাকার পুরনো ব্যবসায়ী বা বাসিন্দারা কেউই এমন নামের কোনও লোকের হদিস দিতে পারেননি। এলাকার এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘আমি বহু বছর ধরে এখানে রয়েছি। এমন কারও নাম শুনিনি। এই ঠিকানাও শুনিনি।’’

আরওসি সূত্রের খবর, ত্রিনেত্র-র শেয়ারের মালিক হিসেবে রয়েছে সাতটি সংস্থা। যাদের বেশির ভাগেরই ঠিকানা বালিগঞ্জ প্লেসের একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সেটি আদতে একটি বাঙালি পরিবারের বসতভিটে। বাড়ির এক মহিলা জানালেন, দোতলার একটি অংশ বেসরকারি সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেই দরজা অবশ্য বাইরে থেকে বন্ধ। দরজায় গায়ে কোনও সংস্থার নামও লেখা নেই!

আরওসি সূত্র থেকে জানা গেল, ত্রিনেত্র-র আয়-ব্যয় অডিট করেছেন রবিকুমার ভট্টর নামে এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনি সংস্থার ডিরেক্টরদের খোঁজ দিতে পারেন এই আশায় যাওয়া গেল তাঁর নেতাজি সুভাষ রোডের অফিসে। কিন্তু সেখানেও বিস্ময়। রবির দাবি, তিনি শুধু কাগজপত্র পরীক্ষা করেই সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সংস্থার মালিক কে, কে শেয়ার হোল্ডার, সে সব জানার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বেসরকারি সংস্থাই দালালের মাধ্যমে হিসেবের কাগজপত্র পাঠায়। তেমন ভাবেই ত্রিনেত্র-র কাগজপত্র এসেছিল।’’

ঋণ নিয়ে রহস্য ছিলই। এ বার নয়া রহস্য ত্রিনেত্র-র পিছনে আসল মুখ কারা!

Trinemtra chit fund trinamool congress BJP audit report abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy