Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরমেরু মোরে ডাকে ভাই, দক্ষিণমেরু টানে

এই সময়েই ঘরকুনো বাঙালি ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে হয়ে পড়ে গ্লোবট্রটার মন্দার বোস। আজ নয়, সেই উনিশ শতক থেকেই!পশ্চিমের জায়গাগুলিতে সস্তায় জিনিসপত্র দেখে বাঙালিবাবুদের মুখে ‘ড্যাম চিপ’ শব্দটা বারবার শুনতে-শুনতে স্থানীয়দের কাছে এই বাবুদেরই নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ড্যাঞ্চিবাবু’। ‘ড্যাঞ্চিবাবুদের’ কথা বাংলা সাহিত্যে বিস্তর।

ঊর্মি নাথ
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:১৮
Share: Save:

মধু পুরের রাস্তা হেসে উঠলো। পুজোর পাট তুলে দিয়ে বাবুরা স’রে এলেও, — পোষাকের পাট, — পথে চাঁদের হাট সাজিয়ে দিলে। বিদ্বান্‌, মূর্খ, কর্তা, সম্বন্ধী, সরকার— সব একাকার। পরিবার পরিচারিকার প্রভেদ ঘুচে গেছে। ছেলেমেয়েরা নানা বেশে জনস্রোতে যেন ফুলের মতো হেসে বেড়াচ্ছে।’’ কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভাদুড়ীমশাই’-এর এই লাইনগুলি যেন বাঙালির জীবনের একটা ফেলে আসা অধ্যায়ের ছবি। মধুপুর, দেওঘর, হাজারিবাগ, শিমুলতলা, ঘাটশিলা, রাঁচি, পলামৌ... বাঙালির পশ্চিম। যেখানে ঘুরতে যাওয়া, বলা ভাল হাওয়া বদলে যাওয়া আজ স্মৃতির অতলে।

উনিশ শতকে সাহেবদের দেখাদেখি বাঙালিবাবুরা পশ্চিমে এই সব জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারটা বেশ রপ্ত করে ফেলে। রেলগাড়ি আসার পর বাঙালি আরও সড়গড় হয়। বিভিন্ন আকারের বাক্স-প্যাঁটরা, হোল্ড-অল, স্পিরিট ল্যাম্প, জলের কুঁজো নিয়ে সপরিবারে ট্রেনে করে পশ্চিমে যাত্রা, সেখানে গিয়ে বাড়ি ভাড়া করে লম্বা সময়ের জন্য থাকা, স্থানীয় বাজার থেকে সস্তায় টাটকা মাছ মাংস শাক সবজি কিনে এনে রান্না করে খাওয়া, তার পর বিকেলে সকলে মিলে কাছাকাছি কোথাও হেঁটে বেড়াতে যাওয়া। কোনও এক দিন পাহাড়ে বা নদীর ধারে গরুর গাড়ি করে গিয়ে পিকনিক করা। পাথর সাজিয়ে উনুন করে তার উপরে রান্না। পিকনিকে অধিকাংশ সময়ে মেনু হত খিচুড়ি আলুভাজা কিংবা মাংস-ভাত। এই নির্ভেজাল শান্তিপূর্ণ ছুটি কাটানোর ছবি আজ ইতিহাস।

‘‘একটি শোবার ঘর, একটি বাথরুম, তার পাশেই কাপড় ছাড়ার ঘর, প্রকাণ্ড খাবার ঘর একটি, আর তার পাশে পার্টিশন-দেয়া একটা ঘর বোধহয় চাকদের জন্য, আর তার পরে রান্নাঘর মস্ত চুল্লি-বসানো...দৈনিক দু’টাকায় এতখানি জায়গা আমাদের অধিকারে।’’ বুদ্ধদেব বসু লিখছেন তাঁর ‘গোপালপুর-অন্‌-সী’ প্রবন্ধে। ‘‘শাকসব্জি প্রচুর সস্তা; কিছু সমুদ্রের মাছ, ভেড়ার মাংস। ডিম মুর্গির অভাব নেই। ‘কেলা’ আর ‘কমলালেবু’ ঘরে-ঘরে ফেরি করছে। খুব মিষ্টি লেবু; কলাও চমৎকার; কলকাতার বাজারে এই দুই ফলেরই ও-রকম উৎকর্ষ দুর্লভ। দেখে-শুনে মনে হ’লো এখানে যতদিনই থাকি না কেন অনশনে ক্লিষ্ট হ’তে হবে না।’’ এক দিনের জন্য এসে অনেকগুলো দিন গোপালপুরে থেকে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ওডিশার গোপালপুর পশ্চিমের আউটলাইনের মধ্যে না পড়লেও বাঙালিবাবুদের কাছে ছিল প্রিয় জায়গা। প্রথম দিকে শুধু সাহেবরাই ছুটি কাটাতে যেত। ক্রমে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রাধান্যের এই জায়গা হয়ে ওঠে পুজোয় অন্যতম বেড়ানোর জায়গা।

পশ্চিমের জায়গাগুলিতে সস্তায় জিনিসপত্র দেখে বাঙালিবাবুদের মুখে ‘ড্যাম চিপ’ শব্দটা বারবার শুনতে-শুনতে স্থানীয়দের কাছে এই বাবুদেরই নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ড্যাঞ্চিবাবু’। ‘ড্যাঞ্চিবাবুদের’ কথা বাংলা সাহিত্যে বিস্তর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বুদ্ধদেব বসু— অনেকের লেখায় বারবার উঠে এসেছে হাওয়া বদলের কথা।

পুজোর ছুটিতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছুটি থাকত। প্রতি পুজোয় রবীন্দ্রনাথ নিজেও বেড়িয়ে পড়তেন, কখনও হাজারিবাগ, বুদ্ধগয়া তো কখনও আলমোড়া বা নৈনিতাল। পুজোর ছুটিতে কোর্ট বন্ধ হওয়ার পর পরিবার নিয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মধুপুরে চলে যেতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাজার আগুন। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক জনকে চিঠিতে লিখছেন, ‘‘কলকাতার চেয়ে ঘাটশিলার জিনিসপত্র অনেক সস্তা।’’ ঘাটশিলা থেকে কিছু দূরে গালুডি। ধারাগিরি ফুলডুংরি ঘুরতে গিয়ে সেই সব দিনের বর্ণনা বিভূতিভূষণ ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতেন।

এখন আবার সময়ের এক অন্য খেলা। বাঙালি এখনও পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করে, তবে ব্যাঙ্কক, পাটায়া, সিঙ্গাপুর। হরেক রকম ট্যুর প্যাকেজ আর ট্রাভেল এজেন্সি এই সময়েই তাকে টানে অচিন প্রান্তে। পাহাড়-জঙ্গল-মরুভূমি— সব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE