Advertisement
১১ মে ২০২৪
নৈতিকতার নিয়ম টপকে ফের বিতর্কে

‘বিভ্রান্তি’কে দুষে গবেষণাপত্র ফেরালেন রাজেন

চিকিৎসা-গবেষণার ক্ষেত্রে নৈতিকতার ওই নিয়ম দুনিয়া জুড়ে চালু। অথচ তিনি তাকেই পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তবে শেষমেশ অনিয়মটি ধরা পড়েছে। এ দেশে নয়, বিদেশে।

রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে

রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

চিকিৎসা-গবেষণার ক্ষেত্রে নৈতিকতার ওই নিয়ম দুনিয়া জুড়ে চালু। অথচ তিনি তাকেই পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ।

তবে শেষমেশ অনিয়মটি ধরা পড়েছে। এ দেশে নয়, বিদেশে। আর সেখানকার চিঠিতেই জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা সরকারি হাসপাতালের নামজাদা চিকিৎসকটি কী ভাবে নিয়মের বেড়া ডিঙিয়ে গবেষণাপত্র পাঠিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ চিকিৎসা জার্নালে!

তিনি হলেন রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমের (পিজি) নেফ্রোলজি’র বিভাগীয় প্রধান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে তিনি অবশ্য গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যদিও তাতে বিতর্ক চাপা দেওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোক হিসেবে পরিচিত রাজেনবাবু ক’দিন আগে কুকুর-কাণ্ডে জড়িয়ে বিতর্কের শিরোনামে এসেছিলেন। অভিযোগ, শাসকদলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজির আবদার মেনে তিনি এসএসকেএমে একটি কুকুরের ডায়ালিসিস করাতে উদ্যোগী হন। পাশাপাশি আউটডোরে নিয়মিত রোগী না-দেখার জন্যও রাজেনবাবুর দিকে আঙুল উঠেছে। এ বার গবেষণাপত্রের ঘটনাটি ঠিক কী?

হাসপাতাল-সূত্রের খবর: রাজেনবাবু ২০১৩-য় এনআরএসের শিশু বিভাগের এক ডাক্তারের সঙ্গে যৌথ গবেষণাপত্র পেশ করেছিলেন ‘আমেরিকান জার্নাল অব কিডনি ডিজিজেস’-এ। বিষয়: শিশুদের স্টেরয়েড প্রতিরোধী কিডনির অসুখ ও তার বিকল্প চিকিৎসা। নিয়ম মোতাবেক, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গবেষককে নিজের প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সংক্রান্ত নীতি-কমিটির (এথিক্যাল কমিটি) অনুমোদন নিতে হবে। কমিটি দেখবে, গবেষণার স্বার্থে কোনও রোগীকে যেন অন্যায় ভাবে কাজে লাগানো না হয়।

কিন্তু অভিযোগ: এনআরএসের ওই ডাক্তার নিজের গবেষণার বিষয়টি সেখানকার এথিক্যাল কমিটিতে পাশ করিয়ে নিলেও রাজেনবাবু সে পথে যাননি। এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। দিন কয়েক আগে মার্কিন জার্নালটির কাছ থেকে চিঠি পেয়ে তাঁরা কার্যত আকাশ থেকে পড়েন। চিঠিতে সরাসরি জানতে চাওয়া হয়েছিল, গবেষণার জন্য রাজেন পাণ্ডে এথিক্যাল কমিটির অনুমোদন নিয়েছিলেন কি না। পিজি-কর্তৃপক্ষ জানান, নেওয়া হয়নি।

এমতাবস্থায় রাজেনবাবু গবেষণাপত্র ফিরিয়ে নিয়েছেন। জার্নাল কর্তৃপক্ষের মতে, পুরো ঘটনাটি যারপরনাই দুর্ভাগ্যজনক। রাজেনবাবুও স্বীকার করেছেন, তিনি অনুমতি নেননি। যার জন্য ‘বিভ্রান্তি’কে দায়ী করছেন তিনি। কী রকম?

ওঁর দাবি: এথিক্যাল কমিটির অনুমতির প্রয়োজনীয়তা তাঁর বিলক্ষণ জানা ছিল। ‘‘কিন্তু যাঁর সঙ্গে যৌথ ভাবে গবেষণা করেছি, তিনি বলেছিলেন, যাবতীয় নিয়মপালনের কাজ সেরে ফেলেছেন। এতেই বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’’— যুক্তি রাজেনবাবুর। কিন্তু পিজি’র রোগীদের নিয়েও তো গবেষণা চলেছে! এনআরএসের ডাক্তার পিজি’র এথিক্যাল কমিটিতে কিছু পাশ করাবেন কী ভাবে?

রাজেনবাবুর নিরুত্তর। অন্য দিকে এনআরএসের ওই চিকিৎসক বিশ্বনাথ বসু বলেন, ‘‘আমি এখানে সবটাই পাশ করিয়ে নিয়েছিলাম। তবে জানতাম না, স্যারকেও (রাজেনবাবু) ওখানে করাতে হবে। জানা মাত্র আমরা পেপার ফিরিয়ে নিয়েছি।’’

এর বেশি কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন বিশ্বনাথবাবু। সতীর্থদের অনেকের দাবি: উঁচুতলা থেকে ওঁকে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ‘উঁচুতলা’ হিসেবে খোদ রাজেন পাণ্ডের দিকে আঙুল তুলতেও কসুর করেননি কেউ কেউ।

এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষও গোড়ায় ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলেন। পরে জানাজানি হওয়ায় শোরগোল পড়েছে। প্রবীণ চিকিৎসক তথা এসএসকেএমের এথিক্যাল কমিটির সদস্য এবং নাইসেডের এথিক্যাল কমিটির চেয়ারম্যান সুবীর দত্ত জানিয়েছেন, মানবদেহ সংক্রান্ত যে কোনও গবেষণার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এথিক্যাল কমিটির অনুমোদন নেওয়া আবশ্যিক। ইদানীং এমডি-পড়ুয়াদেরও থিসিসের গবেষণার জন্য তা নিতে হয়। ‘‘গবেষণায় পৃথক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তি যুক্ত থাকলে সব প্রতিষ্ঠান থেকেই অনুমতি নিতে হবে। কোনও চিকিৎসক-গবেষকের এটা না জানার কথা নয়।’’— মন্তব্য সুবীরবাবুর। চিকিৎসা-গবেষণায় ‘এথিক্যাল কমিটি’র গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। ইতিহাস বলছে, নাৎসি আগ্রাসনের সময়ে মানুষকে ‘গিনিপিগ’ করে নানান ওষুধের প্রয়োগ হয়েছিল। যার কুফল দেখে পরে তামাম বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এর পুনরাবৃত্তি রুখতে একজোট হন। বিজ্ঞানীসমাজের এই নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট হয় হেলসিঙ্কি ঘোষণায়— মানুষের উপরে মর্জিমাফিক ওষুধ প্রয়োগ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে না। আর এথিক্যাল কমিটি সেটা নিশ্চিত করবে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিকস (এনআইবিএমজি)-এর অধিকর্তা পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেন, ‘‘এই নিয়ম না-মানা ঘোরতর অনৈতিক। কেন্দ্রীয় বায়োটেকনোলজি বিভাগের ন্যাশনাল বায়োএথিক্স কমিটি এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের বায়োএথিক্যাল গাইডলাইনে এটা স্পষ্ট বলা আছে।’’ এনআইবিএমজি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘নিয়মটা কেউ না-মানলে তাঁকে জেলে ভরা যাবে না ঠিকই। তবে প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে দূরে সরানো উচিত।’’ রাজেনবাবুর ঘটনা শুনে স্থানীয় চিকিৎসকদের অনেকেও বলছেন, এ ভাবে গবেষণাপত্র প্রত্যাহার লজ্জাজনক শুধু নয়, নিয়ম ভাঙার জন্য ওঁর শাস্তিও হওয়া উচিত।

উচিত তো বটে, কিন্তু দেবে কে?

বস্তুত রাজেন পাণ্ডের ‘প্রতিপত্তি’র সুবাদে এটাও ধামাচাপা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখছেন স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ। এই মহলের বক্তব্য:, রাজেনবাবু মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন। মুখ্যমন্ত্রীর মা পিজি’তে ভর্তি থাকাকালীন রাজেনবাবুই ছিলেন তাঁর অন্যতম চিকিৎসক। এবং সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে তিনি নানা অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কুকুর-কাণ্ড থেকে আউটডোর অবহেলা— কোনও ক্ষেত্রেই তাঁর গায়ে আঁচড় পড়েনি।

এ বারও এসএসকেএমের কোনও কর্তা ওঁকে সরাসরি কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেননি। উল্টে প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, ‘‘এখন তো বকলমে উনি আর নির্মল মাজি-ই পিজি চালাচ্ছেন। ওঁদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানে মুখ্যমন্ত্রীর রোষদৃষ্টিতে পড়া।’’

অতএব, চুপচাপ সব দেখে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন ওঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE