Advertisement
০৬ মে ২০২৪
প্রাথমিক শিক্ষার হাল

বাক্য গঠনে অক্ষম, গুণ-ভাগেও কাঁচা

অক্ষর়়জ্ঞান থেকে শুরু করে সাধারণ অঙ্ক— বুনিয়াদেই নড়বড়ে হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। রাজ্য জুড়ে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশই ভাষা ও অঙ্কের ন্যূনতম জ্ঞানে পিছনের সারিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে স্কুলছুট বাড়ার পিছনে একে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদেরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

অক্ষর়়জ্ঞান থেকে শুরু করে সাধারণ অঙ্ক— বুনিয়াদেই নড়বড়ে হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা।

রাজ্য জুড়ে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশই ভাষা ও অঙ্কের ন্যূনতম জ্ঞানে পিছনের সারিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে স্কুলছুট বাড়ার পিছনে একে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদেরা।

নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজ্যের সর্বশিক্ষা মিশন পড়ুয়াদের পড়াশোনার মান যাচাইয়ে নামে। উৎকর্ষ অভিযানই সেই হাতিয়ার। ইউনিসেফের কলকাতা চ্যাপ্টার এবং স্টেট কাউন্সিল অব এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর ২০১৫-র সমীক্ষায় ধরা পড়েছে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশেরই অক্ষরজ্ঞান নেই। নেই গুণ-ভাগ করার ক্ষমতাও। রাজ্যের লক্ষাধিক পড়ুয়ার উপর করা এই সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ৪০ শতাংশ প্রাথমিক পড়ুয়া বিয়োগের হিসেব কষতে জানে না। গুণ করতে গিয়ে হিমশিম খায় ৫০ শতাংশেরও বেশি। কলকাতা শহরেই ৭০ শতাংশ পড়ুয়া গুণ বা ভাগে পিছিয়ে রয়েছে।

অঙ্কের থেকেও অবস্থা খারাপ ভাষা বিভাগের। বাক্য গড়তে পারে না এমন পড়ুয়াই অর্ধেকের বেশি। ৬৪ শতাংশ পড়ুয়া অনুচ্ছেদ পড়তে পারে না ঠিকমতো। নিজে থেকে চার-পাঁচ লাইন লিখতে হলে অবস্থা আরও করুণ। ঠিকঠাক কয়েক লাইন লিখতে পারে মাত্র ২৫ শতাংশ। নড়বড়ে ভিত নিয়ে কোনও ক্রমে চতুর্থ শ্রেণির বেড়া টপকে গেলেও, পঞ্চম শ্রেণি থেকে অনেকেই স্কুলছুট হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার এমন হাল কেন? এ জন্য পড়ুয়াদের মেধা নয়, শিক্ষকদের মনোভাবকেই দায়ী করছেন শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একাংশ। বর্ধমান জেলার এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘নতুন যারা শিক্ষক হয়ে আসছেন অধিকাংশেরই সেই দায়বদ্ধতা নেই। ফলত পড়ুয়াদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই তৈরি হয় না তাঁদের। পড়ুয়ারা নিজেদের অসুবিধার কথা শিক্ষকদের বলতেও পারে না।’’ যদিও এ কথা মানতে নারাজ শিক্ষকদের অন্য অংশটি। তাঁদের বক্তব্য, স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে অধিকাংশ পড়ুয়াই বাড়িতে বা দোকানে অন্য কাজ করে। মিড ডে মিল দিয়ে টেনে এনে যেটুকু পড়ানো হয়, বাড়িতে চর্চা না থাকায় পুরোটাই বিফলে যায়।

রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি স্কুলে দেখা যাচ্ছে পড়ুয়া এবং শিক্ষকের অনুপাতে চরম অসামঞ্জস্যও একটা বড় কারণ। প্রাথমিক স্তরে ৬০ জন ছাত্রছাত্রী পিছু ২ জন করে শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাজ্যে শিক্ষক ঘাটতির জন্য ১০০ জন পড়ুয়াকে পড়াচ্ছেন একজন শিক্ষক— এমন নজিরও মিলেছে। এ ভাবে পড়াতে গিয়ে প্রাথমিক স্তরে প্রতিটি পড়ুয়াকে যতটা যত্ন দেওয়ার কথা, ততটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার প্রতিফলনই ঘটেছে সমীক্ষার রিপোর্টে। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের পর্যবেক্ষণ, ‘‘একজন শিক্ষক কখনওই ৮০ জনকে পড়াতে পারেন না। কিন্তু শিক্ষকের অভাবে একজনকেই হয়তো ৪টি বিষয়ের ক্লাস নিতে হচ্ছে, পড়াতে হচ্ছে অনেক বেশি পড়ুয়াকে।’’ বঙ্গীয় শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘সরকারের শিক্ষানীতিরই ব্যথর্তাই ধরা পড়েছে এই রিপোর্টে।’’

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, উত্কর্ষ অভিযানের রিপোর্ট দেখার পর তাঁরাও চিন্তিত। তবে দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতেই এই সমীক্ষা করা হয় বলে তিনি জানান। ‘‘কোন কোন জেলা পিছিয়ে পড়ছে, তা আমরা নথিভুক্ত করেছি। এ বার চেষ্টা হচ্ছে সেই সমস্ত জেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার। পাশাপাশি, সিলেবাসে বদল করা যায় কি না, নতুন কী ভাবে বাচ্চাদের পড়ানো যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শও করা হবে।’ যেখানে পড়ুয়াদের অবস্থা খুবই খারাপ, সেখানে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা হবে বলে পর্ষদ সূত্রের খবর।

রিপোর্টে কিন্তু এও দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে (যে সব স্কুলে সমীক্ষা করা হয়েছিল) পড়ুয়ারা ঘড়িতে সময় দেখা এবং টাকা গোনার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। শিক্ষাবিদেরা জানাচ্ছেন, গ্রামের ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই বাহ্যিক জগতের সঙ্গে বেশি মেশার ফলে এগুলো সহজেই বুঝে নিতে পারে। প্রস্তাব এসেছে প্রাথমিকের পাঠ্যক্রমকে তাই করে তুলতে হবে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Primary Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE