Advertisement
০৫ মে ২০২৪

‘যাবেন না’, পড়ুয়াদের টানে থাকলেন স্যার

সকাল ৬টায় বর্ধমান থেকে বাস ধরে ৪২ কিলোমিটার ঠেঙিয়ে রায়নার গোতান বাসস্টপ। সেখান থেকে কখনও কোনও সহকর্মী শিক্ষকের মোটরবাইক, কখনও চেয়ে নেওয়া সাইকেলে চেপে ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি।

ছাত্রছাত্রীদের আবদারের কাছে হার মানলেন প্রধান শিক্ষক রামকৃষ্ণ যশ। রায়নার স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।

ছাত্রছাত্রীদের আবদারের কাছে হার মানলেন প্রধান শিক্ষক রামকৃষ্ণ যশ। রায়নার স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
রায়না শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৬ ০৪:১২
Share: Save:

সকাল ৬টায় বর্ধমান থেকে বাস ধরে ৪২ কিলোমিটার ঠেঙিয়ে রায়নার গোতান বাসস্টপ। সেখান থেকে কখনও কোনও সহকর্মী শিক্ষকের মোটরবাইক, কখনও চেয়ে নেওয়া সাইকেলে চেপে ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি। কে স্কুলে আসছে না, কার শরীর খারাপ, কার বাড়িতে সমস্যা, কে পড়া বুঝতে পারেনি— সব জেনে তাদের মুশকিল-আসান করে স্কুলে আসা। স্কুলের যাবতীয় কাজ সেরে দিনের শেষে আবার ভিড়-বাসে বর্ধমান সদরে ফেরা।

টানা পঁচিশ বছর, সপ্তাহে অন্তত চার দিন কোনও প্রধান শিক্ষকের এমন ‘রুটিন’ হলে সহজে কি তাঁকে ছেড়ে দেওয়া যায়? ‘‘যায় না’’, জবাবে এককাট্টা রায়নার সুবোধ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের সেই আবদার, অধিকার, জেদের সামনে পড়েই হার মেনেছেন প্রধান শিক্ষক রামকৃষ্ণ যশ। শারীরিক সমস্যার কারণে শিক্ষা দফতরে বাড়ির কাছের স্কুলে বদলির আর্জি জানিয়ে, ‘মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার’ পেয়েও বৃহস্পতিবার রামকৃষ্ণবাবুকে বলতে শোনা গেল, ‘‘এত ভালবাসা উপেক্ষা করার শক্তি নেই। কী করে যাব?’’

১৯৮৯-এ ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে সুবোধ মেমোরিয়ালে যোগ দেন রামকৃষ্ণবাবু। ২০০২ থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। এক সময় যে স্কুলে সাকুল্যে সাড়ে তিনশো পড়ুয়া ছিল, এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় তেরোশোয়। এক সময়ের একতলা টিনের চাল দেওয়া স্কুলের আজ দোতলা ঝকঝকে পাকা-বাড়ি। গত কয়েক বছর ধরে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার ১০০ শতাংশ।

অন্য শিক্ষকেরাই জানান, এই পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর রামকৃষ্ণবাবু। স্কুলের সব প়ডুয়ার হাল-হকিকত তাঁর নখদর্পণে। কাউকে এক দিনের জায়গায় দু’দিন স্কুলে না দেখলে ফোনে খোঁজ নেন। ‘বেগতিক’ বুঝলে হাজির হন বাড়িতে। ‘‘ভাল করে খাওয়া-দাওয়া কর’ আর ‘শরীর সারলেই স্কুলে আসবি’—কত জন যে শুনেছি স্যারের মুখে’’, জানাল স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির অদিতি সরকার, দশমের পার্থপ্রতিম সাহা-রা। সহকর্মীরা জানালেন, যাঁদের মোটরবাইকে চেপে রামকৃষ্ণবাবুর ‘অভিযান’, দিনের-দিন তাঁদের তেলের টাকা দিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর মানুষটির।

অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন, এমনও হয়েছে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন রামকৃষ্ণবাবু। একটু একটু করে স্কুলের পরিবেশটাকে ভাল লাগাতে চেষ্টা করেছেন। কাজও হয়। টাকার কথা ভেবে স্কুলের চৌকাঠ না মাড়ানোদের কারও কারও খরচও ‘হেড-স্যার’ নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন, সহকর্মীরা টানছেন এমন উদাহরণ। এমন শিক্ষক স্কুল পাল্টাতে চান রটে গিয়েছিল আগেই। বৃহস্পতিবার রামকৃষ্ণবাবু স্কুলে ঢুকতেই জড়িয়ে ধরে প়ড়ুয়ারা। সবার একটাই কথা, ‘‘আমাদের ছেড়ে যাবেন না স্যার।’’ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারাও স্কুলের গেটে জড়ো হন। স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক তথা স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র জুলফিকার আলি জানান, গ্রামে স্যারের ‘টহল’ সবার চেনা। পড়ুয়াদের পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছে। আর এক প্রাক্তন ছাত্র, রানিগঞ্জের স্কুলের শিক্ষক সুব্রত পাল বলেন, ‘‘স্যার না থাকলে স্কুল অভিভাবকহীন। জেনেবুঝে তো অভিভাবককে চলে যেতে দেওয়া যায় না!’’

কিন্তু প্রতিদিন ৮৪ কিলোমিটার যাওয়া-আসা এবং সেই সঙ্গে এই এলাকা ‘টহলে’ কষ্ট হয় না? বর্ধমান শহরের কানাই-নাটশাল এলাকার বাসিন্দা রামকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘নবাবহাট থেকে এমনিতে সকাল ৮টার বাস ধরি। আর ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি গেলে ৬টার বাস। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের পরে সপ্তাহে পাঁচ দিন পড়ুয়াদের বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বয়স হচ্ছে তো..!’’ সেই সঙ্গে শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে ‘মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার’ চাওয়া রামকৃষ্ণবাবুর পরের গন্তব্য ছিল বর্ধমান শহর লাগোয়া বেলকাশ পিপি ইনস্টিটিউশন। তাঁর বাড়ি থেকে ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যেই সেই স্কুল। এ বার কী হবে? রামকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘জানিয়ে দেব, যাচ্ছি না। অবসর নেব এই স্কুল থেকেই।’’ শিক্ষকের সহধর্মিনী ডলি যশ হাসছেন। বলছেন, ‘‘বাড়ির কাছে স্কুল হলে ভাল হতো। কিন্তু যে লোকটা ছাত্রছাত্রীদের জন্য অসুস্থ শরীর নিয়েও স্কুলে গিয়েছে, সে কি সে টান কাটাতে পারে? আর সবাই যে ভাবে ওঁকে চাইছে, তার পরে আমি হলেও স্কুল বদলাতাম না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teacher School Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE