Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ডিগবাজি কেন, টাটার প্রশ্ন রাজ্যকে

সিঙ্গুরের জমি নিয়ে ভাবনা কী, জানতে চায় কোর্ট

পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতে দাঁড়িয়ে বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করেছে! সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এমন অদ্ভুত অবস্থান নিতে গিয়ে আজ ফাঁপরে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

সিঙ্গুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা। —ফাইল চিত্র।

সিঙ্গুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা। —ফাইল চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০৪:০১
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতে দাঁড়িয়ে বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করেছে! সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এমন অদ্ভুত অবস্থান নিতে গিয়ে আজ ফাঁপরে পড়ল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

আদালতে রাজ্য যুক্তি দিয়েছিল, বাম জমানায় সঠিক পদ্ধতি মেনে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ হয়নি। অথচ অতীতে কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক হয়েছিল বলেই যুক্তি দিয়ে এসেছে রাজ্য সরকার। রাতারাতি অবস্থান বদলে টাটাদের প্রশ্নের মুখে পড়েছে রাজ্য। টাটা মোটরসের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি অভিযোগ তোলেন, সরকার বদলাতে পারে। কিন্তু রাজ্য এই ভাবে বদলাতে পারে না। নিজের তিন-তিনখানা হলফনামার উল্টো অবস্থান নিচ্ছে রাজ্য। মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অন্য কারও সম্পর্কে দোষারোপ করে বলছে, ওরা ভুল করেছে। ওদের জেলে ঢোকান। অথচ রাজ্য এ সব কথা নিজের সম্পর্কেই বলছে! টাটাদের এই অভিযোগ মেনে নিয়েছে আদালতও। বিচারপতি ভি গোপালাগৌড়া বলেন, একে হাল্কা ভাবে নেওয়া চলবে না। কারণ হাইকোর্টে রাজ্যের অবস্থান একেবারে ভিন্ন ছিল।

প্রশ্নের মুখে রাজ্যের আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী জবাব দিয়েছেন, সরকার বদলের সঙ্গে রাজ্যের রংও বদলে যায়। এখন রাজ্যে যে দলের সরকার, তারা সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেই ক্ষমতায় এসেছিল। তাই বামেদের বেআইনি ভাবে নেওয়া জমি ফিরিয়ে দেওয়াটা শুধু বিধানসভার সিদ্ধান্তই নয়, সেটা মানুষের রায়। বস্তুত রাজ্যের আইনজীবী মুখ খোলার আগেই বিচারপতিরা আঁচ করেছিলেন, তিনি জমি নেওয়াকে বেআইনি বলবেন। টাটার আইনজীবীও কটাক্ষ করেন, রাজ্যের অবস্থান গোপন কিছু নয়। তাঁদের সেই অনুমানই সত্যি হয়।

রাজ্যের এই অবস্থানের প্রেক্ষিতে আদালত টাটাদের কাছে জানতে চেয়েছে, তারা সিঙ্গুরের জমি ধরে রেখে কী করতে চায়? এর আগে টাটারা বলেছিল, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে তারা জমি ছেড়ে দিতে পারে। এখন তাদের কী অবস্থান?

জবাবে টাটাদের আইনজীবী গোপাল জৈন বিচারপতিদের জানান, টাটা মোটরস কর্তৃপক্ষের সবুজ সঙ্কেত নিয়ে তিনি আদালতকে চূড়ান্ত অবস্থান জানাবেন। তবে নীতিগত ভাবে এটি সঠিক প্রস্তাব। যদি ক্ষতিপূরণ ঠিক করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি হয়, যেখানে টাটা ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বোঝাপড়ার সুযোগ থাকবে, সে ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নিয়ে টাটা সিঙ্গুর থেকে সম্মানজনক ভাবে বিদায় নিতে পারে।

তবে শেষ পর্যন্ত এই পথেই সিঙ্গুর-জট কাটবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি ভি গোপালাগৌড়া মন্তব্য করেন, যদি সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণটাই বেআইনি বলে আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, সে ক্ষেত্রে টাটাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না।

বস্তুত সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে দিতে মমতা সরকারের আইন সাংবিধানিক কি না, তা ফয়সালা করার আগে বাম আমলে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ আইন মাফিক হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে চাইছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালতে রাজ্যের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গুরে কোন কোন মৌজার জমি নেওয়া হবে, তা আগেই বাম মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। টাটাদের ছোট গাড়ির কারখানার জন্যই যে জমি নেওয়া হচ্ছে, তা-ও মন্ত্রিসভার নোটে স্পষ্ট। তার দু’মাস পরে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। প্রথমে টাটারা খড়্গপুরে ৬০০ একর জমি চিহ্নিত করেছিলেন। তাতেও মন্ত্রিসভা সম্মতি দিয়েছিল। পরে তারা সিঙ্গুরে ১০০০ একর জমি চায়। মন্ত্রিসভা তাতেও সায় দেয়। সিঙ্গুরে ১০৫৩ একর জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি টাটা হাউসিংয়ের জন্য আরও ২০০ একর জমি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নয়।

বিচারপতি গোপালাগৌড়া মন্তব্য করেন, নিয়মমাফিক আগে রাজ্য শিল্পায়নের জন্য জমি চিহ্নিত করবে। কোথায় কৃষি জমি কম লাগছে, কোথায় জমির উর্বরতা কম, কোনটা বহুফসলি জমি নয়, কোথায় কম মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে, সেই সব দেখতে হবে। তা না করে আগেই মন্ত্রিসভা জমি চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের নির্দেশ দেয়। যা দেখে মনে হচ্ছে, টাটারাই বাইরে থেকে সব কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল। টাটারা কোন এলাকায়, কী ধরনের জমি চাই বলতে পারে। কিন্তু মৌজা ধরে জমি চিহ্নিত করে দিতে পারে না। জনস্বার্থের কথা বলে শিল্পায়নের জন্য নয়, আসলে টাটাদের জন্যই জমি অধিগ্রহণ করেছে রাজ্য। সে ক্ষেত্রেও টাটাদের উপর অধিগ্রহণের যাবতীয় খরচ মেটানো, কর্মসংস্থান, এলাকার উন্নয়নের মতো যে সব শর্ত আরোপ করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। বিচারপতি প্রশ্ন করেন, কী ভাবে রাজ্যের শিল্পোন্নয়ন নিগম টাটাদের হয়ে জমি অধিগ্রহণ করে কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারি কোষাগারের ১৩৮ কোটি টাকা ব্যয় করে? বাজেটের কোন খাতে এই অর্থ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে? যাদের জমি দেওয়া হয়েছে, তাদেরকেই অধিগ্রহণের খরচ মেটাতে হবে।

টাটার তরফে সিদ্ধার্থ মিত্র যুক্তি দিয়েছেন, রাজ্যের কাছে নির্দিষ্ট মৌজা ভিত্তিক জমি চেয়ে টাটারা কখনও চিঠি লেখেনি। মন্ত্রিসভায় কেন মৌজা ধরে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হল, তা টাটার জানা নেই। রাজ্য সরকার জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করেছে। তা-ই কৃষকদের ক্ষতিপূরণও রাজ্যই মিটিয়েছে। টাটারা সেই খরচ দেয়নি। তারা শুধু জমির ভাড়া দিয়েছে। রাজ্য চেয়েছিল, এমন শিল্প আসুক, যার হাত ধরে অন্য শিল্পও আসবে। উত্তরাখণ্ডের মতো কর ছাড় ও অন্যান্য সুবিধার আশ্বাসেই সিঙ্গুরে টাটা লগ্নিতে রাজি হয়। এই কারখানা হলে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু বিচারপতি মন্তব্য করেন, তা-ই বলে সব আইন শিকেয় তুলে রাখা যায় না।

বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে, টাটাই জমি বেছে দিয়েছে। তার পরে সেই উর্বর জমি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিল্পের মতো কৃষিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তিনফসলি উর্বর জমি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রাজ্যের কাছে জানতে চান, কীসের ভিত্তিতে টাটাদের গাড়ি কারখানার নামে সিঙ্গুরের বহুফসলি জমি নেওয়া হল? খড়্গপুর থেকে সিঙ্গুরে এসে কেন টাটারা বাড়তি ৪০০ একর জমি চাইল, এ জন্য টাটারা কি কোনও প্রোজেক্ট রিপোর্ট দিয়েছিল? মন্ত্রিসভার নথি পেশ করলেও সেই নথি দেখাতে পারেনি রাজ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Singure Supreme Court CM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE