নিহত অনিল মাহাতো। শুক্রবার অভিজিৎ সিংহের তোলা ছবি।
মাওবাদী হামলায় খুন হননি বাঁকুড়ার রাইপুরে তৃণমূলের ব্লক কার্যকরী সভাপতি অনিল মাহাতো। প্রাথমিক তদন্তের পরে জেলা তৃণমূলের একাংশের খাড়া করা এই ‘তত্ত্ব’ খারিজ করল পুলিশ। উল্টে পরিবার ও শাসক দলেরই একাংশের তরফে খুনের কারণ হিসেবে উঠে এল তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ।
বৃহস্পতিবার রাতে ওই নেতাকে খুনের পিছনে মাওবাদীদের হাত থাকার যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন জেলা তৃণমূলের নেতা তথা জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী, শুক্রবার তা ধোপে টেকেনি। জেলার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরার কথায়, ‘‘ঘটনায় মাওবাদী যোগ পাইনি।’’ পুলিশ সুপার খুনের কারণ স্পষ্ট না করলেও নিহতের স্ত্রী সুলেখা মাহাতো মনে করছেন, অনিলবাবু ব্লক সভাপতির পদ পেতে পারেন—দলের অন্দরে সম্প্রতি শুরু হয়েছিল এমন জল্পনা। সেই আক্রোশে দলে বিরুদ্ধ গোষ্ঠী হামলা করেছে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও মনে করছেন, যে জায়গায়, যে ভাবে খুনটি হয়েছে, তা স্থানীয় যোগসূত্র ছাড়া সম্ভব নয়।
মটগোদা থেকে ছ’ কিলোমিটার দূরে ধানঘরি গ্রামে দলের সর্বক্ষণের কর্মী অনিলবাবুর বাড়ি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি দলীয় কার্যালয়ে যান। রাতে সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের মোটরবাইক স্টার্ট করার সময়েই হামলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জগন্নাথ নামাতার দাবি, তিনটি মোটরবাইকে চার জন এসে অনিলবাবুর পাশে দাঁড়ায়। দু’জনের মুখে কাপড় বাঁধা, বাকি দু’জনের মাথায় হেলমেট ছিল। জগন্নাথবাবুর কথায়, ‘‘ওদের মধ্যে তিন জন অনিলদাকে গুলি করে।’’ রাইপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি বছর পঁয়তাল্লিশের অনিলবাবুকে। পুলিশ সূত্রের খবর, ৯ মিলিমিটার পিস্তলের তিনটি গুলি তাঁর বুকে বিঁধেছে।
সুলেখাদেবীর অভিযোগ, ‘‘দলের ব্লক সভাপতি জগবন্ধু মাহাতোর সঙ্গে স্বামীর বনিবনা ছিল না। স্বামীকে দলের ব্লক সভাপতি করা হবে বলে শোনা যাচ্ছিল। তা আটকাতেই বিরুদ্ধ গোষ্ঠী ওঁকে খুন করেছে।’’ পরিবারটির দাবি, পারলৌকিক কাজকর্ম মিটিয়ে তারা নির্দিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবে।
তৃণমূলে অনিল-ঘনিষ্ঠেরা আবার প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া অনিলের দেহরক্ষীকে নিয়ে। হামলার সময়ে সেই দেহরক্ষীকে কেন দেখা যায়নি, সে প্রশ্নে ক্ষুব্ধ তাঁরা। প্রশ্ন উঠেছে রাইপুর থানার টহলদার-গাড়ির গতিবিধি নিয়েও। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মিনিট আগে রাত সওয়া ৯টা নাগাদ ওই পুলিশ-ভ্যান ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যায়। ফেরে হত্যাকাণ্ডের মিনিট সাতেক পরে। শুক্রবার রাতে ওই টহলদার ভ্যানে থাকা এক সাব ইনস্পেক্টরকে পুলিশ সুপার ‘ক্লোজ’ করায় জল্পনা বাড়ে। তবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘ক্লোজ করার সঙ্গে খুনের সম্পর্ক নেই। দেহরক্ষীর হাজির না থাকার বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’
অনিল-হত্যায় দোষীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন রাইপুরের বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ করেন তাঁর অনুগামীরা। তাঁদের বক্তব্য, তৃণমূলের ব্লক সভাপতি কার্যত সেই ব্লকের ‘একচ্ছত্র অধিপতি’। ওই পদে থাকা অনেক নেতা মনে করেন, সংগঠন তো বটেই, পুলিশ-প্রশাসনের কাজেও নাক গলানোর অধিকার রয়েছে তাঁদের। এর উপরে ব্যক্তি বিশেষে যোগ হয় ‘তোলাবাজি’র প্রবণতা। কিন্তু ব্লক কার্যকরী সভাপতি সে সবে সহমত না হলেই বিরোধ বাধে। এ ক্ষেত্রেও প্রায় তেমনটাই হয়েছে।
তৃণমূলের রাইপুর ব্লক সভাপতি জগবন্ধুবাবু অবশ্য সব অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন, ‘‘এর সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সম্পর্ক নেই। প্রয়োজনে সিআইডি-তদন্ত হোক।’’ জেলা সভাধিপতি অরূপবাবু বলেন, ‘‘মাওবাদীদের কায়দায় খুন বলে প্রথমে ওদের সন্দেহ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, আততায়ীদের পিছনে বিরোধী-মদত আছে।’’
ঘটনাচক্রে, এ দিনই মটগোদায় সিপিএমের লোকাল কমিটির অফিসে আগুন লাগানো এবং সে সময় শূন্যে গুলি ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্রের মন্তব্য, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কাদের, খুনের পিছনে কারা—সবই জানে তৃণমূল। মাঝখান থেকে আমাদের নাম জড়িয়ে পার্টি অফিসে আগুন লাগানো হল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy