E-Paper

বঙ্গের সরকার দুর্গতের পাশে, লেখা গ্যারাজে

শাহজাহানের অবশ্য শুধু যে হংসবাহিনী নয়, অন্য বাহিনীও আছে তা শুক্রবারই হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। শুক্রবার সাতসকালে ইডি, সিআরপি এবং ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিকদের ঠেঙিয়েই বিরত হয়নি তারা।

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:২৪
শেখ শাহজাহানের বাড়ির গ্যারেজে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণে বিলির ত্রিপল।

শেখ শাহজাহানের বাড়ির গ্যারেজে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণে বিলির ত্রিপল। —নিজস্ব চিত্র।

সাদা, নীল, হলুদ, তিনটি অট্টালিকাই যেন থমথম করছে। জনমানুষের সাড়াশব্দ নেই। শুধু উঠোনময় সশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল রাজহাঁস। তারা অবশ্য যে-সে রাজহাঁস নয়। সন্দেশখালির ‘সম্রাট’ শাহজাহানের পোষ্য। এ হেন হংসবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে একটু ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া। ভিতরের দরজা অবশ্য হাট করে খোলা। দিনের বেলাতেও বারান্দায় আলো জ্বলছে! ঘরের ভিতরে জামাকাপড় ঝুলছে। বারান্দায় সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে, পড়ে আছে শিশুদের খেলনা। তবে ‘ভিতরে কেউ আছেন’ বলে ডাকাডাকি করলে কোনও সাড়া মেলেনি। অগত্যা হাঁসেদের পাশ কাটিয়েই বেরিয়ে আসতে হল। শাহজাহানের বাড়িতে ইডি-র তল্লাশি করতে আসার জেরে লঙ্কাকাণ্ডের পরের দিন এমনই চিত্র তাঁর বাড়ির।

শাহজাহানের অবশ্য শুধু যে হংসবাহিনী নয়, অন্য বাহিনীও আছে তা শুক্রবারই হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। শুক্রবার সাতসকালে ইডি, সিআরপি এবং ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিকদের ঠেঙিয়েই বিরত হয়নি তারা। দিনভর দাপিয়ে বেড়িয়েছিল সন্দেশখালিতে। শাহজাহানের ‘ডেরা’ আকুঞ্জিপাড়ায় ঢোকার পরে সঙ্গী চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনতাইও হয়েছিল। পরে কাকুতি-মিনতি করে ক্যামেরা ফেরত পেলেও মেমরি চিপ থেকে সব ছবি মুছে দিয়েছিল সেই বাহিনী। এ দিন শাহজাহানের অন্য বাহিনীকে তেমন দেখা যায়নি। শুক্রবারের মতো উত্তাপও ছিল না। বরং এলাকা বেশ ঠান্ডা। গাড়ি নিয়েই তাই শাহজাহানের বাড়ির সামনে চলে যাওয়া যাচ্ছিল।

শুক্রবার শাহজাহান-বাহিনীকে দেখেছিলাম। পুলিশকে তেমন ভাবে দেখিনি। এ দিন অবশ্য রাজ্যের আইনরক্ষকদের কয়েক জনকে শাহজাহানের বাড়ির ঢিলছোড়া দূরত্বেই বসে থাকতে দেখেছি। অট্টালিকার পাশে দু’টি ছোট মাপের একতলা বাড়িও আছে শাহজাহানের। তার একটিতে দাপুটে তৃণমূল নেতার মা থাকেন। সেখানেও তালা ঝুলছে। কেউ কোত্থাও নেই। তবে শাহজাহানের প্রতিবেশীরা বাড়িতেই আছেন। তাঁরা জানেন না যে ভোজবাজির মতো শাহজাহানের গোটা পরিবার কোথায় উবে গিয়েছে। প্রশ্ন করলেই শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন।

শাহজাহানের বাহিনীও কি নেতার পিছুপিছু চম্পট দিয়েছে? বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছু ক্ষণ পরে অবশ্য মোটরবাইকে চেপে দুই যুবক হাজির হলেন। শুক্রবারের শাহজাহানের পেয়াদারা যেমন আচরণ করেছিলেন, এঁদের আচরণ তেমন মোটেও নয়। বরং গলায় অতিরিক্ত বিনয় ঝরিয়েই বললেন, ‘‘শুক্রবার বাড়িতে শাহজাহানের মা এবং স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। ইডি জোর করে বাড়িতে ঢুকতে যেতেই পাড়ার লোকেরা রেগে গিয়ে আক্রমণ করে ফেলেছেন। ইডি-ই স্থানীয়দের মারতে যাওয়ায় গোলমাল আরও বেড়ে যায়।’’ এ হেন অভিযোগ গুরুতর বটেই। তবে দু’জন অসুস্থ মহিলা কোথায়, সেই প্রশ্নের অবশ্য উত্তর দেননি। শাহজাহান যে এলাকা ছেড়েছেন সে কথা মেনে নিয়ে এক যুুবক বললেন, ‘‘দাদা (শাহজাহান শেখ) চলে যাওয়ার পরে এলাকার লোকেরা খুবই মুশকিলে পড়েছেন। গরিব মানুষের মসিহা ছিলেন উনি।’’ এ হেন ‘মসিহা’ না থাকায় তাঁর প্রাসাদে এসে মাঝেমধ্যে দেখভাল করছেন তাঁরা। মনে হল জিজ্ঞাসা করি, শাহজাহানের বাড়িতে চুরি করবে, এমন চোর সন্দেশখালিতে আছে? তবে সেই প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে দুই যুবক উধাও হয়ে গেলেন।

উত্তাপহীন ছিল সরবেড়িয়ায় শাহজাহানের ‘শেখ শাহজাহান মার্কেট’ও। বাজারের ভিতরে একটি হুডখোলা জিপ দাঁড়িয়ে। জিপের মালিক কে, সে বিষয়ে মার্কেটের দোকানিদের মুখে কুলুপ। একটু এগোতেই অবশ্য হাতে হ্যাঁচকা টান লাগল। গায়ে মলিন জ্যাকেট, মুখে বিড়ি, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ। একটু তফাতে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘শাহজাহানের ফাঁসি হলে আমার কলজে জুড়োবে। আমার তিন বিঘা জমি মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে লুটে নিয়েছে। এখন অন্যের জমিতে মজুর খাটি।’’

শাহজাহানের বাড়ি ছাড়ার আগে চোখ পড়েছিল উঠোনে থাকা গ্যারাজে। বেশ পেল্লাই গ্যারাজ। তার চাতালে ত্রিপলও টাঙানো।

তাতে লেখা, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার দুর্গত মানুষের পাশে।’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

TMC Shahjahan Sheikh ED

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy