Advertisement
২৮ মার্চ ২০২৩
Mid Day Meal

স্কুলে হঠাৎ রন্ধনকর্মীদের ঝাঁ-ঝকঝকে সজ্জায় বিস্ময়

মিড-ডে মিলের হালহকিকত দেখতে কেন্দ্রীয় দলের আগমন উপলক্ষে স্কুলের এই সাজো সাজো রব নিয়ে দু’রকম তির্যক মন্তব্য শোনা যাচ্ছে বিরোধী শিবির-সহ নানা মহলে।

Mid Day meal inspection in a school

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সোনারপুরের এক স্কুলে কেন্দ্রের মিড-ডে মিল পরিদর্শক দল। সোমবার। ছবি: সুমন বল্লভ

আর্যভট্ট খান
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৪৯
Share: Save:

রন্ধনকর্মীদের হাতে গ্লাভস। মুখে মাস্ক। হোটেল-রেস্তরাঁর কর্মীদের ধাঁচে মাথায় আবরণও! চাল, ডাল, আলু, রান্না করা খাবার— সবই ঢাকা দেওয়া। গৃহস্থ বাড়িতে গণ্যমান্য অতিথি এলে যেমন সব কিছু টিপটপ করে সাজিয়ে রাখা হয়, স্কুলে স্কুলে তেমনই সজ্জা বাংলায়। স্কুলের রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘরকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

Advertisement

মিড-ডে মিলের হালহকিকত দেখতে কেন্দ্রীয় দলের আগমন উপলক্ষে স্কুলের এই সাজো সাজো রব নিয়ে দু’রকম তির্যক মন্তব্য শোনা যাচ্ছে বিরোধী শিবির-সহ নানা মহলে। এক দলের কটাক্ষ, কে বলবে কিছু দিন আগেই এই বঙ্গেরই স্কুলে মিড-ডে মিলে টিকটিকি, ডালের বালতিতে মরা সাপ দেখা গিয়েছিল! অন্য দলের উক্তি, তা হলে দেখা যাচ্ছে, চেষ্টা করলে পড়ুয়াদের খাবার পরিচ্ছন্ন ভাবে রান্না করা যায়! এমন প্রশ্নও উঠছে, পড়ুয়াদের খাবারে টিকটিকি-সাপ আবিষ্কারের কয়েক দিন পরেই যখন কেন্দ্রীয় দল পরিদর্শনে এল, ভোল একেবারে পাল্টে গেল কী করে?

সোমবার সকালে বিকাশ ভবনে রাজ্যের শিক্ষাসচিব মণীশ জৈন এবং অন্যান্য কর্তার সঙ্গে বৈঠক করে ১১ জন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি বেরিয়েছিলেন স্কুলে খাবারের হাল দেখতে। দলের প্রধান পুষ্টিবিদ অনুরাধা দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, “মিড-ডে মিলের মান যাচাইয়ে ৩২টি সূচক আছে। সেই সব সূচকের ভিত্তিতে সব খতিয়ে দেখা হবে। এটা রুটিন পরিদর্শন। সব রাজ্যেই চলছে।”

বিকাশ ভবন থেকে প্রতিনিধিদের গাড়ি ছুটল রাজারহাটে। সঙ্গে রাজ্যের প্রতিনিধিরা। রাজারহাটের বনমালীপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছবির মতো সাজানো ফুলের বাগান। মিড-ডে মিলের নির্দেশাবলি স্পষ্ট করে লেখা দেওয়ালে। রান্নাঘরে গ্লাভস, মাস্ক, অ্যাপ্রন, মস্তকাবরণ পরে রান্না করছেন কর্মীরা। আপনারা কি রোজই গ্লাভস, অ্যাপ্রন পরে রান্না করেন? মাথা নাড়লেন কর্মীরা। অনুরাধা রান্নাঘরে ঢুকে বাংলাতেই কর্মীদের জিজ্ঞেস করলেন, কতটা চাল নেওয়া হয়েছে? ক’জন বাচ্চা উপস্থিত? এক কর্মী বললেন, ৮১ জন পড়ুয়ার জন্য সাত কিলোগ্রাম চাল নেওয়া হয়েছে। কম নয়? মাথাপিছু তো ১০০ গ্রাম চালও হচ্ছে না? অনুরাধার প্রশ্নের জবাবে কর্মী বলেন, সবাই ১০০ গ্রাম চালের ভাত খায় না। ডিমের ঝোল, ভাত আর আপেল ছিল মেনুতে। ডিমের ঝোলের জন্য সাত কেজি আলু নেওয়া হয়েছে শুনে একটু অবাকই হলেন অনুরাধা। কর্মীরা জানালেন, বাচ্চারা আলু খেতে ভালবাসে। তাই আলু বেশি নেওয়া হয়েছে।

Advertisement

কথা ছিল উত্তর ২৪ পরগনার স্কুলে ঘুরবেন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের কালিকাপুর বাসন্তীদেবী বালিকা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হল কনভয়। তত ক্ষণে পড়ুয়াদের খাওয়া শেষ। তবু মিড-ডে মিলের কর্মীরা ঝকঝকে নতুন টুপি, অ্যাপ্রন পরে আছেন। রাঁধুনিরা জানান, মেনুতে ছিল মটরশুঁটি ও টোম্যাটো দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, ডাল, ডিম সেদ্ধ। খাওয়ার পরে হাত ধোয়ার জায়গা, রাঁধুনিদের হাত কতটা পরিষ্কার, নখ কাটা আছে কি না— সবই খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হল। কয়েক জন ছাত্রীর ওজন, উচ্চতা এবং জিভ পরীক্ষা করে খাতায় লিখে নিলেন বিশেষজ্ঞেরা। খাবারও চেখে দেখলেন কেউ কেউ।

পড়ন্ত বিকেলে সোনারপুরেরই অতুলকৃষ্ণ রায় বিদ্যায়তন ফর গার্লসে গিয়ে অ্যাপ্রন-সজ্জিত রন্ধনকর্মীদের দেখা গেল। স্কুলের ভিতরে যখন বিশেষজ্ঞেরা সব ঘুরে দেখছেন, তখন বাইরে কয়েক জন অভিভাবকের অভিযোগ, এই অ্যাপ্রন এবং গ্লাভস রোজ থাকে না। যদিও এই অভিযোগ পৌঁছয় না দিল্লির প্রতিনিধিদের কাছে।

দিল্লির প্রতিনিধিদলের এ ভাবে স্কুলের খাবার পরিদর্শন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষক সংগঠনদের একাংশে। শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারীর প্রশ্ন, “এ ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে এসে কী লাভ?” প্রশ্ন উঠল, পড়ুয়াদের খাওয়ার সময় প্রতিনিধিরা থাকলেন না কেন?

রাজ্যের মিড-ডে মিল ঘিরে নানান অভিযোগ আসায় রাজ্যে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার। পাল্টা আক্রমণে তৃণমূলের রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক সুখেন্দুশেখর রায়ের দাবি, ‘‘কোথাও কোনও অভিযোগ ওঠেনি। অভিযোগ যদি কেউ করে থাকেন, তা করেছেন বিজেপি রাজ্য নেতারা। তাই ওই কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে গিয়েছে।’’

কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের দাবি, চলতি অর্থবর্ষে বঙ্গের মিড-ডে মিল খাতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৮৪২.৩৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সুভাষের অভিযোগ, ওই খাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদেয় যে-‘ম্যাচিং গ্র্যান্ট’ বা আংশিক অর্থ জমা পড়ার কথা, তা এখনও জমা পড়েনি। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের মতে, রাজ্য যদি নিজেদের খাতের টাকা না-দেয়, পরবর্তী কিস্তির টাকা ছাড়তে সমস্যা হবে কেন্দ্রের। তাতে সমস্যায় পড়বেন রাজ্যের পড়ুয়ারা। সুখেন্দুর দাবি, ‘‘একশো দিনের কাজ প্রকল্পের পরে এ বার গরিব পড়ুয়াদের পেটে আঘাত করতে চাইছে বিজেপি সরকার। যাতে গরিবদের মধ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ বুঝতে পারছেন, কেন্দ্রীয় স্তরে বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বলেই পশ্চিমবঙ্গকে এ ভাবে বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.