আকাশ কালো করে এলেই এখনও বুক ঢিপ ঢিপ করে রমেন সর্দারের। মাটির দেওয়াল আর টালির চালের এক চিলতে বাড়ির দাওয়ায় বসে বললেন, ‘‘এখানে সকলেই ঘর পোড়া গরু। কপালে যা আছে, মেনে নিয়েছি। কিচ্ছু করার নেই।’’
রমেনবাবু একা নন, সুন্দরবনের বহু মানুষের এ ভাবেই কাটে দিন-রাত। কারণটা আয়লা।
২০০৯ সালের ২৫ মে বিধ্বংসী আয়লার তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গিয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা। বহু প্রাণহানি, সম্পত্তির ক্ষতি হয়। চাষের জমি, মাছচাষের পুকুরে নোনা জল ঢুকে সব তছনছ করে দেয়। অনেকে পরপর কয়েকটা বছর ওই জমি-পুকুরে চাষ করতে পারেননি। পেশা বদলাতে হয়েছে কত জনকে। ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে বেরিয়ে আর ফেরেনি গাঁয়ের কত না মেয়ে, তার খোঁজ কে রাখে!
সুন্দরবনের পরিবেশ যে বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, সে কথা অবশ্য অনেক দিন থেকেই জানিয়ে আসছিলেন পরিবেশবিদেরা। আরও বেশি করে ম্যানগ্রোভ লাগানোর জন্য বহু সচেতনতা শিবির, সরকারি প্রকল্পের কথা ছিল। কিন্তু সে সবই কথার কথা থেকে গিয়েছে। বরং পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, দিন দিন বাড়ছে সুন্দরবনের জলস্তর। দুর্বল হচ্ছে বহু নদীবাঁধ। যে কোনও সময়ে আয়লার মতো দুর্যোগে সব ছারখার হয়ে যেতে পারে।
বাম আমলের শেষের দিকে কথা হয়েছিল, সুন্দরবনে কংক্রিটের বাঁধ দেওয়া হবে। কাজ কিছুটা শুরুও হয়েছিল। কিন্তু পুরো কাজ কবে শেষ হবে, জানেন না কেউ। কোথাও সরকারি কর্তাদের দাবি, জমির অভাবে কংক্রিটের নদীবাঁধের কাজ এগোয়নি। কোথাও বাসিন্দাদের আবার পাল্টা বিস্ময়, জমি দিলেও সরকার কাজে নামল কোথায়?
গোসাবার লাহিড়িপুর, সাতজেলিয়া, কুমিরমারি, দুলকি, ছোট মোল্লাখালি, আমতলি, সোনাগাঁ, বাসন্তীর ত্রিদিবনগর, ঝড়খালি ৪, পার্বতীপুর, শহিদনগর, বিরিঞ্চিবাড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকায় নদীবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। যখন-তখন বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে পড়ে। ভেসে যায় বাড়ি ঘর। চাষের জমি জলের তলায় তলিয়ে যায়। সেচ দফতরের তরফ থেকে কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ মেরামত করে। কিছু দিন পরে সেই বাঁধ ফের ভেঙে যায়। এলাকার মানুষের প্রশ্ন, এ ভাবে আর কত দিন চলবে?
আয়লার পরে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যানিং, গোসাবা-সহ বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সুন্দরবনে কংক্রিটের নদীবাঁধ তৈরি করা হবে। যাঁরা নদীবাঁধের জন্য জমি দেবেন, তাঁদের পরিবারের একজনকে চাকরি ও ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হবে। সেচ দফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক বলেন, ‘‘নদীবাঁধ তৈরির ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় জমির সমস্যা রয়েছে। যে কারণে ঠিক মতো কাজ করা যাচ্ছে না।’’ তাঁর দাবি, গ্রামবাসীরা জমি দিতে চাইছেন না দেখেই বাঁধের কাজ সে ভাবে এগোচ্ছে না।
জলের সামান্য ঝাপটাতেও খসে পড়তে পারে এই মাটির বাঁধ।
বহু পরিবার অবশ্য উল্টো দাবিই করল। তাঁদের বক্তব্য, জমি দিয়ে কাজ হয়নি। কেউ চাকরি পায়নি। এমনকী, ২০০৯ সালের ঘটনায় এখনও ক্ষতিপূরণও পাননি অনেকে। তাঁদের ক্ষোভ, ভোটের সময়ে সব দলের নেতানেত্রীরা এসে কংক্রিটের বাঁধ তৈরি করবেন বলে বড় বড় কথা বলে যান। ভোট মিটলেই সব চুপচাপ। যে তৎপরতা বা উদ্যোগ দেখানো যেত, তার সিকিভাগও দেখতে পাননি এই সব মানুষগুলো। বালি ১-এর এক জমিদাতা বলেন, ‘‘বাঁধ নির্মাণের জন্য এক কাঠা জমি দিয়েছি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছুই পাইনি।’’ গোসাবার সাতজেলিয়া, কুমিরমারির বাসিন্দা অরবিন্দ মণ্ডল, পলাশ নায়েক বলেন, ‘‘সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। সুন্দরবনে স্থায়ী বাঁধ তৈরি না হওয়ায় আমরা সব সময়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকি। যদি আবার বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়, তা হলে আর রক্ষা নেই। ধনেপ্রাণে মরতে হবে।’’
সেচ দফতর জানায়, বাসন্তী ব্লকের চুনাখালিতে ৭৬২ মিটার, সরানেখালিতে প্রায় ৫০০ মিটার নদীবাঁধ তৈরির কাজ হয়েছে। তা ছাড়া, হাড়ভাঙি, হোগলডুরি, সোনাখালিতে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার নদীবাঁধ তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পথে। অন্য দিকে, গোসাবা ব্লকের আমলামেথিতে ৮০২ মিটার নদীবাঁধ তৈরি হলেও উত্তরডাঙা, বাগবাগান, লাক্সবাগান, লাহিড়িপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় এখনও বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। এখন বালি ১-এ হাজার দেড়েক মিটার পাকা বাঁধের কাজ চলছে।
আয়লায় সুন্দরবনের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদীবাঁধের মধ্যে ৭৭৮ কিলোমিটার নদীবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিল। দুই ২৪ পরগনার প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আয়লা প্রকল্পে নদীবাঁধ নির্মাণের জন্য ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছিল। সেই সময় বাম সরকারকে প্রথম পর্যায়ে ১০০ কোটি টাকাও দিয়েছিল কেন্দ্র। ওই টাকায় কাজ শুরু হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর ক্ষমতায় আসে তৃণমূল সরকার। সরকার পরিবর্তনের পর কাজ আর সে ভাবে এগোয়নি বলে মানুষের অভিযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy