Advertisement
০২ মে ২০২৪
আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

বিপদ লুকিয়ে রয়েছে বাকি অংশেও

বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের ১০০ মিটার ভেঙে প্রাণ গিয়েছে ২৭ জনের। বাকি অংশের হাল দেখে সেতু বিশেষজ্ঞেরা আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের ১০০ মিটার ভেঙে প্রাণ গিয়েছে ২৭ জনের। বাকি অংশের হাল দেখে সেতু বিশেষজ্ঞেরা আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

কেন এমন আশঙ্কা?

এক সেতু বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, উড়ালপুলের এক-একটি স্তম্ভের নকশা এক-এক রকম। এ ছাড়াও, উড়ালপুলটির উত্তর আর দক্ষিণ— দু’দিকের নকশা পুরো আলাদা। এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন মুলুকে বহু সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অলোক সরকার। সেতুর বাকি অংশ খতিয়ে দেখে অলোকবাবুর মনে হয়েছে, উত্তরের স্তম্ভগুলি উড়ালপুলের উপরের অংশের সঙ্গে যে ভাবে আটকানো, দক্ষিণ অংশে তা হয়নি। ওই ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘দক্ষিণের স্তম্ভগুলির ক্ষেত্রে উড়ালপুলের উপরের অংশের সঙ্গে স্তম্ভের ফাঁক দেখা যাচ্ছে। উত্তরের স্তম্ভগুলিতে সেই ফাঁক নেই।’’

দক্ষিণ অংশের ওই ফাঁকই বিপদ ঘটাতে পারত বলে মত সেতু বিশেষজ্ঞদের। কী ভাবে? অলোকবাবু বলেন, ‘‘যান চলাচল শুরু হলে চাপ নিতে পারত না স্তম্ভগুলি। উড়ালপুলের উপরের অংশ থেকে চাপ এলে সংযোগস্থল থেকে সরে যেতে পারে স্তম্ভগুলি। যেমন ৩১ এস স্তম্ভে ইস্পাতের কাঠামো বসাতেই সেটি অনেকটা সরে এসেছে।’’ কংক্রিটের ঢালাই দেওয়ার পরে ৪০ নম্বর স্তম্ভটি ভেঙে পড়ার কারণ এমনও হতে পারে।

রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে একাধিক সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে আইআইইএসটি)-র প্রাক্তনী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জগমোহন কপূর ওই উড়ালপুলের নির্মাণগত আরও একটি ত্রুটির কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, সেতুটির কাঠামো দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বৃষ্টিতে ভেজার ফলে সেতুর ভেঙে পড়া স্তম্ভটির মাথায় ক্যান্টিলিভার গার্ডারের জয়েন্ট প্লেটে মরচে ধরে গিয়েছিল। সঠিক মানের স্টিল না দেওয়াও এর অন্যতম কারণ হতে পারে।

কপূর বলেন, সেতুর গার্ডারের দু’পাশে দু’টি কানের মতো যে অংশ ঝুলে থাকে (যা সেতুর বাকি অংশকে ঝুলে থাকতে সাহায্য করে) তা মূল স্তম্ভের সঙ্গে জয়েন্ট প্লেট দিয়ে আটকানো হয়। এই জয়েন্ট প্লেটগুলি লাগানো হয় গার্ডার প্লেটে দেড় মিলিমিটার মাপের গর্তের মধ্যে দিয়ে। জয়েন্ট প্লেটগুলি আটকানো থাকে ওই গর্তের ভিতর লাগানো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নাট বোল্ট বা হাই টেনসাইল স্টিল নাট বোল্ট দিয়ে।

ইস্পাতের কাঠামো স্তম্ভটি থেকে অনেকটা সরে গিয়েছে।

গত চার-পাঁচ বছর ধরে গার্ডারের উপরের অংশ ঢালাই না হওয়ায় জয়েন্ট প্লেটে মরচে ধরে গর্তের মাপ বেড়ে গিয়েছিল বলে মত কপূরের। তিনি বলেন, ‘‘গর্তের মাপ বড় হয়ে যাওয়ায় বোল্টের ক্ষমতা কমে যায়। তাই ঢালাই করায় সেতুর ভার আর নিতে পারেনি নাটগুলি। সেগুলি বেঁকে যাওয়াতেই স্তম্ভের দু’টি কান ভেঙে পড়ে।’’ নজরদারির অভাবই এর কারণ বলে মত কপূরের। অন্য কোনও স্তম্ভে এমন নজরদারির অভাব থাকলে উড়ালপুলটি আদৌ যান চলাচলের যোগ্য থাকে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কপূর।

কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারেরাও উড়ালপুল-কাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। নকশার ত্রুটি, নিম্ন মানের কাঁচা মাল এবং নির্মাণকাজে প্রযুক্তিগত ত্রুটির উল্লেখ
করেছেন তাঁরা।

ওই ইঞ্জিনিয়ারদের মনে হয়েছে,
• ৪০ নম্বর স্তম্ভটি ছিল এই উড়ালপুলের অন্য সব স্তম্ভের চেয়ে আলাদা। ওই স্তম্ভের উপরে ক্যান্টিলিভার তৈরি করে তার উপর দিয়ে গার্ডার দুটি বসানো হয়েছিল। প্রযুক্তিবিদদের মতে, ওই স্তম্ভের উপরে তৈরি করা ক্যান্টিলিভারটি ওই গার্ডারের ভার নিতে পারেনি। তার কারণ, এই স্তম্ভে যে গার্ডার বসানো হয়েছিল, সেটি লম্বায় ছিল ৪০ মিটারের বেশি। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত টানা গার্ডার থাকে।

• স্তম্ভের সঙ্গে ক্যান্টিলিভারটি যে সব নাট বোল্ট দিয়ে জোড়া ছিল, সেগুলি কতটা মজবুত ছিল, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তা ছাড়া, স্টিল গার্ডার সেতুতে ঝালাই করার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে ঢালাইয়ের দিন সকালে নাট বোল্ট খুলে যাওয়ায় ঝালাই করে তা ফের বসানো হয়েছিল। ঢালাইয়ের ওজন পড়তেই সেটা আবার ভেঙে যায়।

ওই ইঞ্জিনিয়ারেরাও মনে করেন, উড়ালপুলের সব স্তম্ভে একই ধরনের ত্রুটি ছিল কি না সেটাই দেখা দরকার। কারণ ওই ত্রুটি থাকলে উড়ালপুল দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হলেই বিপদের আশঙ্কা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bridge flyover collapse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE