Advertisement
E-Paper

এখানে পাত্তাই দেন না ডাক্তাররা, যাব না কেন

দোকানে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড, বাজারে বড় রুই-কাতলা থেকে শুরু করে চুনো মাছ, যেখানে পা রাখবেন সেখানেই বাংলায় কথাবার্তা। এক মুহূর্তের জন্যও কারও মনে হওয়ার জো নেই যে, রাজ্যটা পশ্চিমবঙ্গ নয়।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৫৪
ভেলোরে বাংলা সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি। ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের সামনে। (ডান দিকে) খড়্গপুরের মন্দিরা সরকার। — নিজস্ব চিত্র

ভেলোরে বাংলা সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি। ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের সামনে। (ডান দিকে) খড়্গপুরের মন্দিরা সরকার। — নিজস্ব চিত্র

দোকানে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড, বাজারে বড় রুই-কাতলা থেকে শুরু করে চুনো মাছ, যেখানে পা রাখবেন সেখানেই বাংলায় কথাবার্তা। এক মুহূর্তের জন্যও কারও মনে হওয়ার জো নেই যে, রাজ্যটা পশ্চিমবঙ্গ নয়।

মনে হওয়ার জো নেই, এই ‘মিনি বাংলা’ আসলে তামিলনাড়ুতে!

সরকারি হাসপাতালে সকলের জন্য ফ্রি পরিষেবা কিংবা সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতালে আধুনিকতর প্রযুক্তির আশ্বাস— সবই আছে বাংলায়। তবু চিকিৎসার জন্য বাঙালি এখনও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে দক্ষিণে। হাওড়া থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের আর এক নাম এখনও ‘চিকিৎসা এক্সপ্রেস’। দমদমের উড়ান চেন্নাইয়ে নামলে এখনও দেখা যায়, বিস্তর ফাইলপত্র নিয়ে হুইলচেয়ারে বসা রোগীকে নামিয়ে হিমসিম খেতে খেতে হাসপাতালে দৌড়চ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের অজস্র মানুষ।

চেন্নাইয়ের মেডিক্যাল কলেজ, অ্যাপোলো, মিয়ট, ফর্টিস হাসপাতাল, ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ— সর্বত্র এক ছবি। প্রত্যেকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষই জানাচ্ছেন, তাঁদের মোট রোগীর ৬০ শতাংশই আসেন পূর্বাঞ্চল থেকে, মূলত পশ্চিমবঙ্গ থেকে।

একটা নয়, এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে দু’টো। ১) আরোগ্যের আশায় কেন বাংলা ছেড়ে দলে দলে দক্ষিণমুখো বাঙালি? ২) এত রোগী যদি দক্ষিণে যান, তার পরেও এ রাজ্যের হাসপাতালগুলোতেও উপচে পড়া ভিড় হয় কী করে? কলকাতার এক প্রবীণ চিকিৎসক বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে— ‘‘অনেকেই এ রাজ্যে ডাক্তার দেখান। তার পরে ‘সেকেন্ড ওপিনিয়ন’ নিতে দক্ষিণে যান। কিংবা পশ্চিমবঙ্গে দেখানোর পরে আস্থা হারিয়ে দক্ষিণে ছোটেন। তা ছাড়া জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে ভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে, তাতে দু’জায়গায় ভিড় দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’

ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে সিঁড়িতে বসে হাঁফাচ্ছিলেন খড়্গপুরের মন্দিরা সরকার। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের রোগী। গত ১০ বছর ধরে বছরে দু’বার ভেলোরে এসেই চিকিৎসা করান। এত দূর এসে ডাক্তার দেখানোর ধকল নেন কেন? মন্দিরাদেবীর সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘বিশ্বাসটা আছে বলে।’’ কেন এই বিশ্বাস নিজের রাজ্যের ডাক্তারদের ওপর রাখতে পারছেন না?
তাঁর উত্তর, ‘‘ওখানে রোগী ভর্তি থাকলে ডাক্তারবাবুরা দাঁড়িয়ে কথা বলার সৌজন্যটুকুও দেখান না। ওঁরা হাঁটেন, পেছনে রোগীর বাড়ির লোকজন ছোটেন।’’

বরাহনগরের নরেন সাঁতরার মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হবে ভেলোরে। এক আত্মীয়কে নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে পৌঁছেছেন। অস্ত্রোপচারের পরেও থাকতে হবে বেশ কিছু দিন। কলকাতায় অস্ত্রোপচার করালেন না কেন? নরেনবাবুর জবাব, ‘‘কলকাতায় এক ডাক্তারবাবুকে দেখিয়েছিলাম। এত রাশভারী, কোনও প্রশ্ন করে জবাব পাই না। এখানে নিজের রোগটা কী, অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি কতটা— সবই জেনে গিয়েছি।’’ বর্ধমানের খোসবাগানের মোহনগোপাল দাসের মস্তিষ্কে টিউমার। অস্ত্রোপচার করাতে এসেছেন। বললেন, ‘‘টিউমার ধরা পড়ার পরে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সবাই বলল, ‘ভেলোর চলে যাও।’ কলকাতাতেও খরচ করতে হবে। এখানে এলেও করতে হবে। কিন্তু এখানে এসে অনেক বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করছি।’’

এই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই চেন্নাই এবং ভেলোরের যে সব এলাকায় হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে থাকার জায়গা তৈরি হয়েছে অজস্র। শুধু হোটেল নয়, রয়েছে গেস্ট হাউস। বাড়ি ভাড়াও পাওয়া যায়। চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে ক্যানসার আক্রান্ত একমাত্র সন্তানের চিকিৎসার জন্য এসেছেন টালিগঞ্জের দিবাকর চৌধুরী। মোট পাঁচ জনের দল। দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন মাসিক ২০ হাজার টাকায়। ২৫ বছরের ছেলের অগ্ন্যাশয়ের অস্ত্রোপচার করাতে এসেছেন তপতী হালদার। উঠেছেন ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের সামনে ছোট একটা হোটেলে। তারই সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘দিনে ৩০০ টাকা ভাড়া। পরিষ্কার বাথরুম, পরিষ্কার বিছানা। আপাতত এটুকুতেই চলবে।’’

চেন্নায়ের মিয়ট হাসপাতালের আউটডোরে তিন বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন আগরপাড়ার সুমি চৌধুরী। মেয়ে এত দিনেও ভাল করে কথা বলতে শেখেনি, তাই তাকে দেখাতে এনেছেন। ফর্টিস হাসপাতালে দেখা মিলল আনসার আলির। পায়ের অস্ত্রোপচার করাবেন। তাঁরও যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তাররা বেশির ভাগ সময়েই ‘রেগে থাকেন’। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায় না।

মানুষের এই ভরসাই যে তাঁদের মূলধন, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন চেন্নাই অ্যাপোলোর নিউরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘ডাক্তারের কাছে রোগী যদি স্রেফ একটা নম্বর হয়ে ওঠেন, তা হলে সমস্যা। কারণ ওই রোগী কারও না কারও সন্তান, স্বামী, স্ত্রী কিংবা বাবা-মা। তাঁদের কাছে এই মানুষগুলো ‘স্পেশ্যাল’। ডাক্তারও যদি প্রত্যেক রোগীকে এই ‘স্পেশ্যাল’ অনুভূতিটা দেন, তা হলে সেখানেই চিকিৎসার প্রথম ধাপটা শুরু হয়ে যায়।’’ একই বক্তব্য চেন্নাইনিবাসী হেপাটোলজিস্ট আনন্দ রামমূর্তি কিংবা কার্ডিওলজিস্ট পল রমেশ-এর।

এ রাজ্যের চিকিৎসকদের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ যে আছে, তা মেনে নিয়েছেন ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে এখানকার সব স্তরের কর্মীদের সঙ্গেই ওখানকার কর্মীদের ব্যবহারের পার্থক্য আছে। বহু রোগীই বলেছেন, এখানে ডাক্তাররা তাঁদের পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেন না। তার মধ্যেই পরের রোগীকে ডেকে নেন।’’ পাশাপাশি রয়েছে খরচের পার্থক্যও। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার কোনও বড় বেসরকারি হাসপাতালে বড় অস্ত্রোপচারের যা খরচ, ওখানকার বেসরকারিতে খরচ তার চেয়ে কম। হয়তো ওখানে রোগীর সংখ্যা বেশি বলেই ওরা খরচটা তুলনায় কম রাখতে পেরেছে।’’

মেডিসিন-এর চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় তুলে ধরলেন অন্য একটি দিক। তাঁর কথায়, ‘‘দক্ষিণের বেসরকারি হাসপাতালগুলির মার্কেটিংও বেশ শক্তিশালী। তাদের এখানে অফিস রয়েছে। এজেন্টরা বহু জায়গায় ঘোরাঘুরি করে রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’’ তা ছাড়া একই ছাদের নীচে সামগ্রিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকাটাও দক্ষিণকে এগিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের একাংশ। এক দরজা থেকে আর এক দরজা, এক কাউন্টার থেকে আর এক কাউন্টারে ঠোক্কর খেয়ে বেড়ানোর হয়রানিটা সেখানে অনেক কম। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দক্ষিণের হাসপাতালগুলিতে যোগাযোগ করা অনেক সহজ। ই-মেল করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা যায়, রিপোর্ট পাঠিয়ে মতামত জানা যায়। কিন্তু ওখানেও অনেক ভুলত্রুটির অভিযোগ ওঠে। সেগুলো তেমন প্রচারে আসে না।’’

চর্চার অবকাশ থেকে যায় এখানেই। দক্ষিণে একেবারেই কোনও সমস্যা নেই, এমন তো নয়। এই যে এক বার চিকিৎসা করিয়ে ফিরে আসার পরে ‘ফলো আপ’ করা, সেটাই তো এক মস্ত ঝামেলা।

তবু দক্ষিণের মোহ কাটে না কিছুতেই।

(চলবে)

South Indian patients hospitals
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy