Advertisement
১৭ মে ২০২৪
Super Specialty Hospital

জেলায় সুপার স্পেশালিটি সত্ত্বেও কলকাতায় কেন

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বিনা মূল্যে। তবু কেন চিকিৎসা করাতে না-পেরে মৃত্যু ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর?

representational image

—প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:১৬
Share: Save:

বাঁকুড়ার শালতোড়ার এক শিশুর রক্তের ক্যানসার হয়েছিল। আট মাস কলকাতার হাসপাতালে থাকার পরে তাকে নিয়ে তার বাবা-মা যখন বাড়ি ফেরেন, তত দিনে তাঁদের এক চিলতে জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। একটানা কামাই করে ঠিকা শ্রমিকের কাজটাও আর নেই। মাসের অর্ধেক দিন কার্যত অনাহারে থাকা পরিবার এর পর আর কলকাতার হাসপাতালে মাসে মাসে আসার ‘বিলাসিতা’টা করে উঠতে পারেনি। বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকে বছর দেড়েক পরে মারা যায়ওই শিশু।

জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ছড়াছড়ি। তার পরেও রোগীদের কলকাতায় আসার বাধ্যবাধকতা কেন? কারণ, যে কোনও জটিল রোগেই, ক্যানসারের মতো রোগের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি করে জেলার মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালগুলি হাত তুলে নেয়। অথচ জেলা স্তরে ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলা নিয়ে আলোচনা আজকের নয়। জেলা হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু তার পরেও মানসিকতায় বদল আসেনি।

এসএসকেএম হাসপাতালের রেডিয়োথেরাপি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অলক ঘোষ দস্তিদার বলছিলেন, ‘‘শিশুদের রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা পেডিয়াট্রিক হেমাটো-অঙ্কোলজিস্টের করার কথা।

রাজ্যে একমাত্র এসএসকেএমেই মাত্র দু’জন পেডিয়াট্রিক হেমাটোঅঙ্কোলজিস্ট আছেন। অন্য কোনও সরকারি হাসপাতালে এখনও নেই। তাই কলকাতায় ভিড় জমে। কিন্তু শিশুদের অন্য কিছু ক্যানসার, যেমন রেটিনোব্লাস্টোমা অর্থাৎ চোখের ক্যানসার বা হাড়ের ক্যানসারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকেরা ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে জেলাতেই চিকিৎসা করেন।’’

সত্যিই করেন কি? আর করলেও তা কত শতাংশ? জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এই ধরনের ক্যানসারে কলকাতায় ‘রেফার’ করা রোগীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় পর্যন্ত জেলায় হয় না। কখনও বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা না হওয়ার দোহাই দিয়ে, কখনও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার না থাকার কথা বলে, কখনও আবার ‘বাচ্চাকে বাঁচাতে চান তো? তা হলে এখানে ফেলে রাখবেন না, কলকাতায় নিয়ে যান’-এর মতো পরামর্শ দিয়ে বাবা-মাকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে জেলার হাসপাতাল দায়িত্ব এড়ায়। জেলায় জেলায় ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তোলার সরকারি দাবির পরেও কেন এমন পরিস্থিতি? দায়িত্ব না নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বললেন, ‘‘কে, কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? সর্বত্রই লবি-র দাপট। আমরা কেউই কোনও লবিকে চটাতে চাই না। কারণ, কখন কোন লবি বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে কেউ জানি না। তাই চোখকান বুজে থাকাটাই দস্তুর।’’

চোখকান এমনই বোজা যে, কোন হাসপাতালে কোন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, সেই বিবেচনা করে নিয়োগের চেষ্টাও হয় না। তা ছাড়া নার্স এবং অন্য কর্মীও দরকার হয়, তা না হলে চিকিৎসা শুরুর পরবর্তী ধাপে সবটাই ধাক্কা খায়, এবং যে কোনও ব্যর্থতার দায় এসে পড়ে শুধু ডাক্তারেরই ওপর। সেই পরিস্থিতিতে ডাক্তার পাশ কাটাতে চাইলে তাঁকেই একক ভাবে দায়ী করা চলে না। মূল বিষয় হল, সুস্থ ভাবে কাজ করার মতো পরিবেশই তৈরি হয়নি অধিকাংশ হাসপাতালে। তাই জটিল রোগে আক্রান্ত কেউ এলে তাকে পত্রপাঠ বিদায় করাটাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। কেন এমন ঘটছে সে নিয়ে ন্যূনতম ভাবনাচিন্তা নেই কোনও স্তরেই। আর তাই, জনগণের করের টাকায় যে পরিকাঠামো তৈরি হয়, তা আদতে কারও কোনও কাজেই আসে না। এমনকি মূল চিকিৎসার পরের ধাপে যে সহায়ক চিকিৎসা এবং ফলোআপ প্রয়োজন, সেই দায়িত্বও জেলায় নেওয়া হয় না।

শুধু কি তাই? শহরেও যে যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে তারও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয় কি? বোনম্যারো প্রতিস্থাপন প্রয়োজন দেগঙ্গার একটি শিশুর। সরকারি জায়গায় সুবিধা করতে না পেরে বাবা-মা রাজারহাটে একটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন চড়া সুদে দেনা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিশুর বাবা বললেন, ‘‘ওই টাকায় চিকিৎসা শেষ করতে পারব কি না জানি না। দেখা যাক কত টুকু এগোতে পারি।’’

তা হলে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি স্তরে এত দাবি, তার ভিত্তিটা কী? সরকারি পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে কেন? স্বাস্থ্যকর্তারা সরাসরি স্বীকার করেছেন, এনআরএসে ওই পরিষেবার হাল তলানিতে। তাই কাগজে-কলমে ব্যবস্থা যা-ই থাকুক, তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না।

স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে বা বাজারে বিস্তর দেনা করে শহরের বেসরকারি হাসপাতালে যাঁরা সন্তানকে নিয়ে ছুটে আসেন, চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার নজির সেখানেও অহরহ। কলকাতার একটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক সোমা দে বলছিলেন, ‘‘শহরে আসার টাকা জোটে না। আর জেলায় চিকিৎসা হয় না। এই অবস্থায় ওই মানুষগুলো তাবিজ-কবচ, তান্ত্রিকে মন দেয়। যে চেষ্টা করে আমরা এক-একটা প্রাণকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার সবটুকুজলে যায়।’’

আবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করেন অনেকে। তার পর টাকা ফুরিয়ে গেলে মাঝপথেই চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। ওই অবস্থায় অর্ধমৃত শিশুকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান বাবা-মা। এসএসকেএম হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলছিলেন, ‘‘কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলিতে উপচে পড়ে ভিড়। সেই অনুযায়ী বেড নেই। ফলে অনেক সময়ে চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়। শিশুদের রক্তের ক্যানসারই বেশি। অত্যন্ত বিধ্বস্ত, সংক্রমণপ্রবণ অবস্থায় হাসপাতালে আসে তারা। ওই অবস্থায় ভর্তি না হয়ে পড়ে থাকার পরিণতি ভয়াবহ। এক দিকে দেরিতে ভর্তি হওয়ার কারণে অনেককে বাঁচানো যায় না। অন্য দিকে সুস্থ করে তোলার পরে ফলোআপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে অকালে চলে যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE