Advertisement
০৬ মে ২০২৪

এটাই রাজ্যের সব চেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল!

বুধবার বিকেলে হাসপাতালের সুপারদের নবান্নে ডেকে মানবিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রোগীর পরিবারের লোকজনকেও পরামর্শ দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— চিকিৎসা নিয়ে ধৈর্য হারাবেন না।

মুর্শিদাবাদের ফতুল্লাপুরের সুজয় দাস। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

মুর্শিদাবাদের ফতুল্লাপুরের সুজয় দাস। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ১০:০৮
Share: Save:

বুধবার বিকেলে হাসপাতালের সুপারদের নবান্নে ডেকে মানবিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রোগীর পরিবারের লোকজনকেও পরামর্শ দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— চিকিৎসা নিয়ে ধৈর্য হারাবেন না। রাত পোয়ানোর আগেই এক রোগীর চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে উঠল রাজ্যের সব চেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম।

হামলার অভিযোগ তুলে বুধবার রাত থেকে হাসপাতালে কর্মবিরতি শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। রাত থেকে পরের গোটা দিন চূড়ান্ত ভোগান্তির শিকার হলেন রোগীরা। তাঁদের অধিকাংশকেই ইমার্জেন্সি থেকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। যাঁদের রেফার করা হয়নি, তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেঝেয় পড়ে থেকেছেন। প্রয়োজনে স্যালাইন, অক্সিজেন তো দূর অস্ত্— ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধা কিংবা রক্তচাপ মাপতেও কেউ আসেনি।

এই পরিস্থিতির পুরোদস্তুর সুযোগ নিয়েছেন এক শ্রেণির দালাল। চড়া দামে ট্রলি, স্ট্রেচার ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে সকলের চোখের সামনেই রোগীদের কাছের নার্সিংহোমে পাঠিয়ে ‘কমিশন’ আদায় করা হয়েছে। সব ঘটনা জেনেও সমাধানের কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়। সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে এ ভাবে আন্দোলনে সামিল হওয়ায় কোনও দোষ দেখছেন না জুনিয়র ডাক্তাররা।

আন্দোলনকারীদের তরফে কৌস্তভ বিশ্বাস এবং সুজন ঘোষ জানান, এই নিয়ে গত এক বছরে পাঁচ বার এসএসকেএমে মার খেলেন চিকিৎসকরা। অথচ নিরাপত্তার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনও কোনও ব্যবস্থাই করেননি। তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের দাবি— জরুরি বিভাগে রোগীর সঙ্গে এক জন করে আত্মীয় ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসকদের সঙ্গে দু’জন করে সাব ইনসপেক্টর পদ মর্যাদার পুলিশ কর্মী রাখতে হবে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে রোগী ভর্তি বন্ধ করতে হবে। হাসপাতাল চত্বরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত করতে হবে।’’ এই সব দাবিদাওয়া নিয়ে অধিকর্তা মঞ্জুদেবীকে ঘেরাও করেও রাখেন তাঁরা।

অন্যান্য বারের মতো এ বারেও গাফিলতির অভিযোগটিতে নতুনত্ব ছিল না। রোগীর পরিজনেরা বলছেন, রোগীকে হাসপাতালে আনার পরে যথা সময়ে চিকিৎসাই শুরু করেননি কর্তব্যরত ডাক্তাররা। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকেন রোগী। তাতেই মেজাজ হারিয়ে ডাক্তারদের ওপরে চড়াও হন তাঁরা। অন্য দিকে, জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, পেশিতে চোট নিয়ে আসা রোগীর চিকিৎসার জন্য ওই পরিস্থিতিতে যা করা দরকার সেটাই তাঁরা করছিলেন। রোগীকে ভর্তি করে নেওয়ার পরে আচমকাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন বাড়ির লোকেরা। প্রায় জনা তিরিশ লোক অর্থোপেডিক বিভাগের জুনিয়র ডাক্তার অভিষেক সিংহকে মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারতে শুরু করে। বাধা দিতে গিয়ে মার খান আরও কয়েক জন।

বার বার এমন ঘটনার পরেও হাসপাতালে নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে না কেন?

এই প্রশ্নে নীরব থেকেছেন মঞ্জুদেবী। তা হলে কি বছরে একাধিক বার এমন কর্মবিরতিতে মুমূর্ষু রোগীদের নাকাল হওয়াটাই ভবিতব্য? উত্তর দেননি তারও। একের পর এক চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটছে, তার উত্তর মেলেনি পুলিশের কাছেও। রবিবার রাতে যাঁরা জুনিয়র ডাক্তারদের ওপরে চড়াও হয়েছিলেন, তাঁদের কয়েক জনকে ধরে ফেলেন জুনিয়র ডাক্তাররাই। সারা রাত নানা বাগ‌্‌বিতণ্ডার পরে এ দিন ভোরে চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

যে রোগীকে নিয়ে এত গোলমাল, উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের বাসিন্দা সেই মুস্তাফিজুর রহমানের শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল।

জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়েছেন, তাঁদের দাবি না মেটা পর্যন্ত কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হবে না। রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, কথায় কথায় ডাক্তারদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া সরকার কিছুতেই মানবে না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভয় দেখিয়ে কিছু আদায় করা যায় না।’’

পাল্টা জুনিয়র ডাক্তাররা বলছেন, অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। এ বার দেওয়ালে পিঠ থেকে গিয়েছে। শেষ দেখেই ছাড়বেন তাঁরা। বেশি রাতে অবশ্য কর্মবিরতি তুলে নেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে।

সত্যরঞ্জন দাস

‘‘আমার ছেলে সুজয় (২৭) তিন ঘণ্টা ইমার্জেন্সি বিভাগের
বাইরে পড়ে ছিল। তরতাজা ছেলেটাকে নিয়ে বুধবার থেকে
কলকাতার সরকারি হাসপাতালে ঘুরছি। প্রথমে
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, তার পরে বৃহস্পতিবার সকালে
এসএসকেএম। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় ছেলেটার গোটা শরীরে চোট।
আমার কাঁধে মুখ গুঁজে সমানে কাতরাচ্ছিল। কিন্তু এখানে ডাক্তাররা
ছুঁয়েও দেখেননি। ইমার্জেন্সি থেকে প্রথমে প্লাস্টিক সার্জারি, তার পর
সেখান থেকে অর্থোপেডিকে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফের ফেরত
পাঠানো হয় ইমার্জেন্সিতে। টানা তিন ঘণ্টা ছেলেটা যন্ত্রণায় কাতরেছে।
ইমার্জেন্সির বাইরে যাত্রী প্রতীক্ষালয়ের বাইরে ওকে শুইয়ে রেখেছিলাম।
কোনওমতে পাঁজাকোলা করে এক বিভাগ থেকে আর এক বিভাগে
ছুটেছি। কেউ জানতে চাননি, কী হয়েছে। মুর্শিদাবাদের ফতুল্লাপুর
থেকে আসছি। শহরের বড় হাসপাতালে এমন ভোগান্তি হবে
জানলে জেলা থেকে আসতামই না। ওখানে চিকিৎসা না হোক,
অন্তত হয়রানিটা হতো না। এখানে চিকিৎসাও
পাচ্ছি না। হয়রানিও দ্বিগুণ।’’


মুর্শিদাবাদের ফতুল্লাপুরের সুজয় দাস। বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

বাঁকুড়ার বড়জোড়ার তাপস মাল। দেবাশিস দাশের তোলা ছবি।

পার্থ আকুলি

‘‘আমার বন্ধু তাপস মালকে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ
থেকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল।
বাঁকুড়ার বড়জোড়া থেকে এসেছি। দিন কয়েক আগে
একটা দুর্ঘটনায় বড়সড় চোট পেয়েছিল তাপস।
স্থানীয় একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম।
কিন্তু সেখান থেকে বলল, সেরে উঠতে গেলে পিজি-তে যেতে হবে।
এর নাম সেরে ওঠা? ডাক্তারদের কাছে তো পৌঁছতেই পারলাম না।
প্রথমে ইমার্জেন্সি থেকে প্লাস্টিক সার্জারিতে পাঠাল।
যে গাড়িটায় বাঁকুড়া থেকে এসেছিলাম, তাতে চড়িয়েই
প্লাস্টিক সার্জারিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর গাড়িটা ছেড়ে দিই।
প্লাস্টিক সার্জারির ডাক্তাররা বললেন, ধর্মঘট
চলছে। কিছু করার নেই।
যেতে হবে ইমার্জেন্সিতে। কিন্তু নিয়ে যাব কীসে? একটা ট্রলি নেই।
যা আছে তা-ও কয়েক শো টাকা ভাড়া চাইছে। প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের
বাইরে কিছু মেরামতির কাজ চলছিল।
শেষ পর্যন্ত বালি ফেলার ভ্যানে চাপিয়ে এক মিস্ত্রি তাপসকে
ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান। ভাড়া নেননি। ওঁদের যে মানবিকতা আছে,
হাসপাতালের কোনও কর্মীর মধ্যে তার ছিটেফোটা পেলাম মা।
ইমার্জেন্সিতে যে ক’ঘণ্টা পড়ে থাকতে হবে জানি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hospital Doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE