Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Communal harmony

‘এ মন্দিরে রাজনীতি নেই’! ওলাইচণ্ডীর মন্দির তৈরিতে এগিয়ে এলেন সদাগর মোল্লা, গোলাম এহিয়ারা

বর্ধমান শহরের অনতিদূরে রায়নার হিজলনা অঞ্চলের বনতির গ্রাম এখন মন্দির নির্মাণে মেতেছে। দেশের বর্তমান পটভূমিতে মন্দিরের কথা উঠলে, অনেকের মনেই তাতে রাজনীতি ঢুকে পড়ার চোরা শঙ্কা দানা বাঁধে।

রায়নার বনতীর গ্রামের সম্প্রীতির সেই মন্দির।

রায়নার বনতীর গ্রামের সম্প্রীতির সেই মন্দির। ছবি: উদিত সিংহ।

ঋজু বসু
বনতির (বর্ধমান) শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৮
Share: Save:

মন্দিরে হাত দেওয়ার আগে ঠিক তার পাশটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের আবক্ষ মূর্তি বসেছিল গ্রামে। এর পরে যখন যেমন টাকা আসছিল, তা দিয়ে পাকা ঘর উঠছিল মা ওলাইচণ্ডীর। টানাটানিতে মূল উদ্যোক্তা রণজিৎ যশের দুশ্চিন্তা দেখে সদাগর মোল্লা, গোলাম এহিয়া মোল্লারা অভয় দেন, “আমরা তো আছি, কাজ কেন বন্ধ হবে!”

বর্ধমান শহরের অনতিদূরে রায়নার হিজলনা অঞ্চলের বনতির গ্রাম এখন মন্দির নির্মাণে মেতেছে। দেশের বর্তমান পটভূমিতে মন্দিরের কথা উঠলে, অনেকের মনেই তাতে রাজনীতি ঢুকে পড়ার চোরা শঙ্কা দানা বাঁধে। কিন্তু বনতিরের ভূমিপুত্র হাই কোর্টের উকিল এক্রামুল বারি সগর্বে বলেন, “এ মন্দিরে রাজনীতি নেই। হিন্দু-মুসলিমে ফারাক কী, ছোটবেলায় বুঝিইনি। কলকাতায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া নিয়ে সমস্যার আগে আমরা হিন্দুর থেকে যে আলাদা, তা কখনও বুঝিইনি!”

এই ২০২৪ সালে বনতিরে যা ঘটছে, ভারতবর্ষের বর্তমান পটভূমিতে তা সত্যিই খানিকটা উলটপুরাণ। গোবিন্দভোগ চালের ঘ্রাণে সুরভিত গ্রাম এখন মন্দির নিয়েই মেতে। তবে গ্রামের ছেলে, ব্যবসায়ী, নেশায় লেখক রণজিৎ বলেন, “আমাদের গ্রামের এ মন্দিরে যশপাড়া, ডোমপাড়া, বাগদিপাড়া, মুসলিমপাড়ার সমান অধিকার। মুসলিমদের দাবিটা বরং বেশিই বলব। ফি বছর ১৫ ফাল্গুন ওলাইচণ্ডীর পুজোয় মুসলিম ঘরে যা কুটুম আসে, আমরা হিন্দুরা ভাবতেই পারি না!”

পুজো বলতে বর্ধমানের এ গ্রাম রামচন্দ্রের অকালবোধন বোঝে না। এখানে পুজো মানে ১৫ ফাল্গুন। মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম বছরভর ১৫ ফাল্গুনের দিকে তাকিয়েই বাঁচে। খুদে চাষি শেখ ওহিদুল হক ওরফে খুদু সহাস্যে বলেন, “আমাদের পুজোর মেলা না দেখলে বুঝবেন না। গাঁয়ের সব বেটা-বেটি ইদ, বকরি ইদের পরবে নাও আসতি পারে, কিন্তু পুজোর টান এড়িয়ে থাকতি পারবে না।”

বর্ধমান শহরের গায়ে কৃষক সেতু পেরিয়েই ফি-বছর মাঝ ফাল্গুনে পোলেমপুর থেকে সাজ-সাজ রব। তখনই গাঁয়ের হিন্দু-মুসলিমের বনতিরে ফেরার ধূম। খুদু মিয়াঁর ছেলে মনিরুল ইসলাম ওরফে বুধন কেরলে ইলেকট্রিকের কাজ ফেলে বছরের ওই সময়েই ছুটিতে গ্রামে ফিরবেন। মেয়ে চম্পা খাতুনও আসবেন পাশের গ্রাম থেকে। পান্ডুয়া, বৈঁচির শ্বশুরঘর থেকে বনতিরের মেয়েরা এ সময় বাপের বাড়ির গ্রামে না ফিরে পারবেই না।

বনতিরের পিরতলার লালন শেখ বলেন, “পুজোর মেলায় আমরা জিলাপি, রসগোল্লা, ল্যাংচা খাব, যাত্রা দেখব, গান শুনব। চাষবাসের কাজে আমাদের জীবনে ছুটির ফুরসত নেই। কিন্তু পুজোর মেলায় চাষবাসের কাম ফেলেই আসতি হবে!”

এ গ্রামের পিরতলার কথায় ওলাইচণ্ডীর প্রসাদী শাঁকালু ধরা হাত জোড় করে কপালে ঠেকান ৮৫ বছরের ‘তরুণ’ সুকুমার মাঝি। স্কুলশিক্ষক প্রশান্ত নাগ, সঞ্জীব মাঝিরা বলেন, “পিরতলার পিরবাবা আর মহামারির রক্ষক ঠাকুরতলার মা ওলাইচণ্ডীই গ্রামটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।” হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে বিয়েশাদিতে নব দম্পতির পিরের থানে পেন্নাম ঠোকা গ্রামের নিয়ম। ‘নবান্নে’র চালও প্রথমে পিরবাবাকে দিতে হবে। আবার অনেক মুসলমানও আপন বিশ্বাসে ওলাইচণ্ডীর কাছে মানত রাখেন। পুজো দেন। ‘ঘেঁটে যায়’ ধর্ম-পরিচয়ের থাকবন্দি বিভাজন।

অধুনা দুর্গাপুরের বাসিন্দা রণজিৎ এখন স্বাধীনতাসংগ্রামীদের নিয়ে বই লিখছেন। সেই সঙ্গে ওলাইচণ্ডী মন্দিরের আটচালা আর পিরতলার তোরণ তৈরির কাজ শেষ করাও তাঁর পণ। মন্দির-রাজনীতির দিনকালে এ গ্রামের মন্দিরের কথা উঠলে ফুঁসে ওঠেন রণজিৎ বা এক্রামুলের ভাই নাসিমুল। বলেন, “ধর্মের থেকেও বেশি এ মন্দিরে গ্রামের ঐতিহ্য মিশে।” দেশের অন্যত্র মন্দির-রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে চানও না তাঁরা। এ মন্দিরের পুরোহিত তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে রাজমিস্ত্রি আব্দুর আজিজ মোল্লার এক সুর, “এটুকু বলব, এ মন্দির কাউকে দুঃখ দিয়ে তৈরি হচ্ছে না। এখানে কোনও রাজনীতি নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Communal harmony Bardhaman hindu Muslim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE