Advertisement
E-Paper

ঘুষের খবরে পরীক্ষা দিতেই যাননি অনেকে

খাতায়-কলমে প্রায় ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী। প্রচুর বাস-ট্রেন চালিয়ে, স্কুলে-কলেজে শিক্ষক-কর্মীদের রবিবারের ছুটি বাতিল করে পরীক্ষা কেন্দ্র খুলে বিপুল আয়োজন। তিন বছর বাদে, ২০১২-র পরে এই আবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৮

খাতায়-কলমে প্রায় ২৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী। প্রচুর বাস-ট্রেন চালিয়ে, স্কুলে-কলেজে শিক্ষক-কর্মীদের রবিবারের ছুটি বাতিল করে পরীক্ষা কেন্দ্র খুলে বিপুল আয়োজন। তিন বছর বাদে, ২০১২-র পরে এই আবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ।

কিন্তু টেট পরীক্ষায় ফাঁকা পড়ে রইল বহু আসনই। তার একটা বড় কারণ যদি হয় লাখ-লাখ টাকায় চাকরি বিক্রির খবরে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হওয়া প্রবল অনাস্থা, অন্য কারণ অবশ্যই লাগামহীন অ্যাডমিট কার্ড বিলি, যার দায় রাজ্যের শিক্ষা দফতর এড়াতে পারে না।

ফর্ম জমা দিয়েও পরীক্ষা দিতে যাননি বারাসতের সঞ্জয় হুমানিয়া। কেন? সোমবার সঞ্জয় বলেন, ‘‘চারদিকেই শুনছি, টাকা দিয়ে চাকরি হচ্ছে। তাই ভাবলাম, ফালতু শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?’’ কেবল তাঁদের উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই প্রায় এক লাখ পরীক্ষার্থী ফর্ম ভরেও কেন্দ্রে উপস্থিত হননি।

অনেক জেলাই সোমবার পর্যন্ত উপস্থিতির সঠিক হার জানাতে পারেনি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এক মাত্র কোচবিহারেই উপস্থিতির হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। কিন্তু শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়িতে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ পরীক্ষার্থী গরহাজির। কেন এঁরা এলেন না? জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল পরিদর্শক তৃপ্তি গুহের বক্তব্য, “সেটা বলা মুশকিল। হয়তো অন্য কোনও চাকরিতে চলে গিয়েছে!”

বিভিন্ন জেলায় যে সব অফিসার পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা অনেকেই হতবাক। বর্ধমান জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “ব্লকভিত্তিক রিপোর্ট দেখে আমরা তো তাজ্জব!” টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রও বলেন, “ভেবে পাচ্ছি না, এত বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী এলেন না কেন!”

তাঁদের বোধগম্য না হলেও স্কুল শিক্ষা দফতরের কর্তারা একটা সম্ভাব্য কারণের কথা বলছেন এবং তার জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন পরীক্ষার্থীদেরই। এক কর্তার ব্যাখ্যা, ২০১২-য় যাঁদের অ্যাডমিট কার্ড ও ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’ ছিল তাঁদের আর ফর্ম তোলার প্রয়োজন নেই এবং আগের বার যে কেন্দ্রে তাঁরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন এ বারও সেখানেই দেবেন বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুরনো পরীক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ ফের ফর্ম জমা দিয়েছেন। ফলে, এঁরা প্রত্যেকে একাধিক অ্যাডমিট কার্ড পেয়েছেন। কর্তার মতে, ‘‘পরীক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা ২৩ লক্ষের চেয়ে অনেক কম বলে আমাদের মনে হয়েছে।’’

এক জন পরীক্ষার্থীর একাধিক অ্যাডমিট থাকাটাই তো অবৈধ। তা হলে? কোনও কর্তার কাছেই এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। বহু চেষ্টা করেও পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। মানিকবাবুর বাড়িতে গিয়েও তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায়নি। বন্ধ ছিল শিক্ষামন্ত্রীর ফোন। তবে পর্ষদ সূত্রের খবর, তাদের পরিকাঠামো এতটাই দুর্বল যে এক প্রার্থীর নামে একাধিক অ্যাডমিট কার্ড আটকানো দূরস্থান, তা জানারও ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যাও দফতরের অজানা।

বিভিন্ন জেলায় পরীক্ষা দিতে না যাওয়া আবেদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অনীহার যে ক’টি কারণ উঠে এসেছে সেগুলি হল:
১) অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের দূরত্ব।
২) পরীক্ষার্থীর বিপুল সংখ্যা এবং তার ফলে চাকরি পাওয়া নিয়ে সংশয়।
৩) শাসকদলের কিছু নেতা আট-দশ লাখ করে টাকা নিয়ে আগেই চাকরি বিক্রি করে দিয়েছেন, এই খবর পেয়ে অনেকেই পরীক্ষাকে স্রেফ ‘প্রহসন’ বলে মনে করেছেন। এবং শেষের কারণটাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।

পাঁশকুড়া স্টেশন বাজারের সুনন্দা ঘোড়াই ২০১২-তেও টেট দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আগের বার পরীক্ষাকেন্দ্র পড়েছিল বাড়ি থেকে বহু দূরে। যাতায়াতেই প্রচুর খরচ হয়েছিল। এ বছরও ওই কেন্দ্রেই যেতে হত। কিন্তু গিয়ে কী লাভ? টাকা দিয়ে তো চাকরি হচ্ছে!’’ কৃষ্ণগঞ্জের টুঙি এলাকার খোকন হালদার বলেন, ‘‘কবে থেকেই তো শুনে আসছি, ৭ থেকে ১০ লাখ টাকায় চাকরি বিক্রি হচ্ছে। আমি তো কাউকে টাকা দিইনি। তাই অহেতুক পরীক্ষা দিতে গেলাম না।’’ পশ্চিম মেদিনীপুরের পরীক্ষার্থী অসিত লৌহ বলেন, ‘‘টাকা ছাড়া যে চাকরি হবে না, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কাকে টাকা দেব, কী ভাবে দেব, তা তো জানতে হবে! তার পরেও দুশ্চিন্তা, যদি টাকা চোট হয়ে যায়।’’

বীরভূমের সিউড়ি ১ ব্লকের এক যুবকের কথায়, ‘‘আমার বোন ফর্ম জমা দিয়েছিল। চাকরি নিশ্চিত করতে নলহাটি ২ ব্লকের এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি প্রথমেই জানতে চান, বোন প্রাথমিক শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়েছে কি না। নেয়নি বলে জানাতেই টাকার অঙ্ক বলা হয় দশ লাখের উপরে। সেটা আমাদের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব ছিল। কিন্তু যেখানে এমন টাকার খেলা চলছে, সেখানে বোন পরীক্ষা দিয়ে কী করবে?’’

উলুবেড়িয়ার এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবক বলেন, ‘‘প্রভাবশালী এক জন পরীক্ষার কয়েক দিন আগে বললেন, ৫ লক্ষ টাকা দিলেই চাকরি হয়ে যাবে। আমি রাজি হইনি। পরীক্ষার আগের দিন তিনি বলেন, অন্তত ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিলেই হবে। চাকরি হলে দিতে হবে বাকি সাড়ে চার লাখ। তখনই বুঝে যাই, পরীক্ষার নামে কী হতে চলেছে। ফলে আর পরীক্ষা দিতে গেলাম না।’’

কৃষ্ণনগরের এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবকের দাবি, পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘পড়াশোনা করে তৈরি হয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে চোখের সামনে মোটা টাকায় প্রশ্ন বিক্রি হতে দেখে মন ভেঙে যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, পরীক্ষায় বসব না।’’

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের মতে, ‘‘আসলে পরীক্ষার্থীদের অনেকেরই মোহভঙ্গ ঘটেছে। তাঁদের মনে হয়েছে, আগে থেকেই যখন সব ঠিক হয়ে রয়েছে, পরীক্ষা দিয়ে আর লাভ নেই।’’

বেশ কিছু পরীক্ষার্থী আবার ২০১২ সালের অ্যাডমিড কার্ডের সঙ্গে ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’-এর রোল নম্বরের মিল না থাকায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। যেমন হরিশ্চন্দ্রপুরের উদয় সাহা বা উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ার বেশ কিছু পরীক্ষার্থী। একই পরীক্ষার্থী একাধিক অ্যাডমিট কার্ড পেয়ে যাওয়া বা ভুল রোল নম্বর আসার দায়ও শিক্ষা দফতরের বলে মনে করছেন পবিত্রবাবুর মতো অনেকে। পবিত্রবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটা দফতরের প্রশাসনিক অদক্ষতা। এ দায় তো তাঁদেরই নেওয়া উচিত।’’

টেট নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এ দিন ইসলামপুরে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় এসএফআই এবং ডিওয়াইএফ। প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গিয়েছে দাবি করে পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানাতে থাকে তারা। রাত পর্যন্ত অবশ্য তেমন কোনও সম্ভাবনার কথা শোনা যায়নি।

tet job selling tet candidate tet skip tet skipping tet bribe
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy