Advertisement
১৮ মে ২০২৪

কপিলের প্রয়াণে হিসেব মতুয়া-অঙ্কের

প্রায় আচমকাই একটি মৃত্যু সংবাদ। তাতে আবার চর্চার মুখে মতুয়া রাজনীতি! ফুসফুসের সমস্যাজনিত রোগে সোমবার প্রয়াত হয়েছেন বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। অসুস্থ হয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৪ বছরের সাংসদ, সেখানেই দুপুরে মৃত্যু হয় তাঁর। শাসক দলের সাংসদ হওয়ার আগেই তাঁর আরও বড় পরিচয়, মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি ছিলেন তিনি।

কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর

কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

প্রায় আচমকাই একটি মৃত্যু সংবাদ। তাতে আবার চর্চার মুখে মতুয়া রাজনীতি!

ফুসফুসের সমস্যাজনিত রোগে সোমবার প্রয়াত হয়েছেন বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। অসুস্থ হয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৪ বছরের সাংসদ, সেখানেই দুপুরে মৃত্যু হয় তাঁর।

শাসক দলের সাংসদ হওয়ার আগেই তাঁর আরও বড় পরিচয়, মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি ছিলেন তিনি। এবং ঠাকুরনগরের মতুয়া বড়মা বীণাপাণি দেবীর বড় ছেলে। তাঁর এই পরিচয়কে কাজে লাগাতে চেয়ে কয়েক মাস আগে কপিলকে দলের মধ্যেই আপত্তি অগ্রাহ্য করে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের টিকিট দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক লক্ষ ৪৬ হাজার ভোটে জিতে দলনেত্রীর আস্থার মর্যাদা রেখেছিলেন কপিল। তাঁর মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, মতুয়া সমীকরণ এ বার কোন দিকে গড়াবে?

সাংসদের মৃত্যুতে বনগাঁয় লোকসভা উপনির্বাচন এখন অনির্বায। তৃণমূলকে যেমন নতুন প্রার্থী খুঁজতে হবে, মতুয়া মহাসঙ্ঘকেও বেছে নিতে হবে নতুন সঙ্ঘাধিপতি। শোকের আবহে রাতারাতি সে কাজ শুরু হয়নি ঠিকই। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, ফের কি ঠাকুরনগরের বড়মার বাড়িতেই লোকসভা ভোটের টিকিট ঢুকবে? বিশেষত, গত লোকসভা ভোটেই যেখানে ওই কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার জোরালো দাবিদার ছিলেন কপিলের ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের ছেলে সুব্রত।

তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত কারও নাম প্রার্থী হিসাবে বেছে নেওয়াই অবধারিত। তার কারণও যথেষ্ট। প্রথমত, গত লোকসভা ভোট বা সাম্প্রতিক দু’টি বিধানসভা উপনির্বাচন সবেতেই শাসক দলের জীবনরেখা হিসাবে দেখা দিয়েছে সংখ্যালঘু ভোট। যার সুযোগ নেওয়ার সুযোগ বনগাঁ লোকসভায় নেই! মতুয়া ভোটই সেখানে তুরুপের তাস! সেই তাস খেলতে বড়মার আশীর্বাদের চেয়ে বড় পাথেয় আর কী হতে পারে?

দ্বিতীয়ত, বনগাঁ লোকসভায় বিজেপি তৃতীয় স্থানে শেষ করলেও তাদের প্রার্থী কে ডি বিশ্বাস ছিলেন মতুয়া মহাসঙ্ঘেরই যুগ্ম সম্পাদক। বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভায় সম্প্রতি বিজেপি-র জয় এবং বর্ধমান-কাণ্ডের জেরে সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদের সঙ্গে যোগসাজশে অভিযুক্ত তৃণমূল এই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে দ্বিগুণ উৎসাহে এ বার ঝাঁপাবেন কে ডি-রা। কপিলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও যিনি এ দিন বলেছেন, “এই আর একটা সুযোগ এল!” সিপিএমও ফের দেবেশ দাসকেই (যিনিও মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি) উপনির্বাচনে দাঁড় করানোর কথা ঘরোয়া ভাবে ভেবে ফেলেছে। নানা কারণে কোণঠাসা তৃণমূলের পক্ষে এই কঠিন লড়াই উতরোনোর সেরা বাজি হতে পারে সেই বড়মার আশীর্বাদই!

এবং তৃতীয়ত, কপিলের চেয়েও মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসূত্র মূলত তাঁর ভাই মঞ্জুলই। রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই যাঁকে মন্ত্রী করেছেন মমতা। তৃণমূলের একাংশ বলছে, কপিলের অনুপস্থিতিতে মঞ্জুলের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েই মতুয়া-বন্ধন আরও দৃঢ় করে নেবেন মমতা! যদিও অন্য একাংশের বক্তব্য, কপিলপন্থীরা এত সহজে ছেড়ে দেবেন না! দুই ভাইয়ের আকচাআকচি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ানোর নজিরও যেখানে আছে! মঞ্জুল-পুত্র সুব্রত যদিও এ দিন বলেছেন, “এ সব কথা এখন বলার মতো অবস্থায় নেই আমরা। আমার ঠাকুরদার (প্রমথরঞ্জন ঠাকুর) মৃত্যুর পরে উনিই (কপিলকৃষ্ণ) অভিভাবক হিসাবে বটগাছের মতো আমাদের আগলে রেখেছিলেন।”

হাসপাতালে কপিলকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দলের ক্ষতির কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁর কথায়, “উনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি ছিলেন। বড়মার পরে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁর মতুয়া সংগ্রাম মানুষ মনে রাখবে। মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে শোকের দিন। আমাদের দলেরও ক্ষতি।” সেই সঙ্গেই ফেসবুকেও পোস্ট করে মমতা যোগ করেছেন, “এই শোকের মুহূর্তে ওঁদের পরিবার এবং আমার মতুয়া সম্প্রদায়ের ভাই-বোনেদের পাশে আছি।” দলনেত্রীর ব্যবস্থাপনাতেই এ দিন ঠাকুরনগরে কপিলের মরদেহ নিয়ে গিয়েছেন মুকুল রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, ইদ্রিস আলির মতো তৃণমূল নেতারা। ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছে মঞ্জুল-পুত্র সুব্রতকে একান্তে ডেকে কিছু কথাও সেরে নিয়েছেন মুকুল। ঠাকুরনগরেই আজ, মঙ্গলবার মরদেহ রাখা থাকবে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। অন্ত্যেষ্টি হওয়ার কথা কাল, বুধবার। কপিলের পরিবারের ইচ্ছাকেই মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

বস্তুত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরে বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন নতুন জমি খুঁজে নেওয়ার তাড়নায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ককে প্রায় আবিষ্কারই করেছিলেন মমতা! উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া-সহ দক্ষিণবঙ্গে মতুয়া সমর্থন তৃণমূলের পালে বাড়তি হাওয়া জুগিয়েছিল। তাঁর মতুয়া-ঘনিষ্ঠতার জেরে তৎকালীন শাসক সিপিএমকে তৃণমূল নেত্রী প্রায় বাধ্যই করেছিলেন মতুয়া মন জয়ের দৌড়ে নামতে। বাম জমানার শেষ দিকে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত থেকে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামাঙ্কিত পুরস্কার নিয়েছিলেন কিন্তু কপিলকৃষ্ণই। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক হরিপদ বিশ্বাসের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর বাম-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূল নানা সময়ে তাঁর সমালোচনাও করেছে। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে অবশ্য সে সবই অতীত হয়ে গিয়েছিল! দিল্লিতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর থেকেই নানা ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এলাকায় কপিলকে বিশেষ দেখা যায়নি ঠিকই। কিন্তু মতুয়াদের ধর্মগুরু হরিচাঁদ গুরুচাঁদের নামে শপথ নিয়ে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে রাতারাতি জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন কপিল।

কপিলের সেই প্রভাব স্বভাবতই নিজেদের দিকে ধরে রাখতে সচেষ্ট হবে তৃণমূল। দলের উত্তর ২৪ পরগনা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় এ দিন বলেছেন, কপিল ছিলেন তাঁদের ‘সম্পদ’। আর ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণ? বৃদ্ধা মা, মতুয়া মহাসঙ্ঘ এবং রাজনীতির দায়িত্ব এখন তাঁকে একাধারে সামলাতে হবে বুঝিয়ে দিয়েই মঞ্জুল বলেছেন, “যত ক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, দায়িত্ব পালন করে যাব। বড়মা, মতুয়া সম্প্রদায়, মুখ্যমন্ত্রী এবং সাধারণ মানুষ আমার সঙ্গে আছেন।”

ইঙ্গিতবাহী? সময়ই বলবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE