—নিজস্ব চিত্র।
বিধানসভা ভোটের পরে রাজ্যে এমনিতেই জোড়া ফুলের রমরমা ছিল সর্বত্র। তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল আরওই কোমর ভেঙে দিল বিরোধীদের! দুই লোকসভা ও একটি বিধানসভা আসনে বিপুল ব্যবধানে জয় পেল শাসক দল। তিন কেন্দ্রেই তাদের প্রাপ্ত ভোট কয়েক মাস আগের বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে বেড়েছে। বস্তুত, উপনির্বাচনে যে দাপট দেখিয়ে তৃণমূল জয় ধরে রেখেছে, তাতে দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ স্থানে কারা থাকল, সেই প্রশ্ন প্রায় অবান্তর! তৃণমূলের জয়ই প্রথম ও শেষ কথা!
পরিসংখ্যান বলছে, বর্ধমানের মন্তেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রয়াত বিধায়ক সজল পাঁজার ২৬ বছরের ছেলে সৈকত জিতেছেন ১ লক্ষ ২৭ হাজার ১২৭ ভোটে। স্বাধীনতার পর থেকে মন্তেশ্বরে এমন একতরফা ফল এই প্রথম! সিপিএম, বিজেপি এবং কংগ্রেস— তিন বিরোধীরই সেখানে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে! তমলুক ও কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের দিব্যেন্দু অধিকারী এবং পার্থপ্রতিম রায় জয়ী হয়েছেন যথাক্রমে ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫২৮ এবং ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ২৪১ ভোটে। তৃণমূলের অন্দরে স্বয়ং দলনেত্রীর দাবি, কোচবিহারে তাঁদের ৪০০% এবং তমলুকে ২২০% ভোট বেড়েছে!
উপনির্বাচনে সাধারণ ভাবে শাসক দলই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কিন্তু নোট-বিতর্কের জেরে বর্তমান পরিস্থিতিতে উপনির্বাচনে তাঁদের জয়কে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শান দিতে দিল্লি রওনা হওয়ার আগে মঙ্গলবার মমতার প্রতিক্রিয়া, ‘‘নির্বাচনের রায়ে গণ-বিদ্রোহ হয়েছে! হিটলারি কায়দায় যে কেন্দ্রীয় সরকার চলছে, তার বিরুদ্ধে মানুষের রায়। এই রায় নোট বাতিলের বিরুদ্ধে। এর থেকে কেন্দ্রের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’’
ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে মন্তেশ্বরে তৃণমূলের বাক্সে গিয়েছে ৭৭.৫৯% ভোট! কোচবিহার ও তমলুকে যথাক্রমে ৫৯.০৩% এবং ৫৯.৭৬%। এর মধ্যে তমলুকে কাগজ-কলমে দিব্যেন্দু জয়ী হলেও নেপথ্যে প্রকৃত বিজয়ী আসলে তাঁর দাদা শুভেন্দু অধিকারীই। বিধানসভা ভোটে তমলুক লোকসভার অন্তর্গত ৭টির মধ্যে তিনটি বিধানসভা আসন হাতছাড়া হয়েছিল তৃণমূলের। এ বার ৭টির মধ্যে ৭টিতেই জোড়া ফুল ফুটিয়ে ছেড়েছেন শুভেন্দুরা। এ রাজ্যে লোকসভার মধ্যে সর্বাধিক জয়ের ব্যবধান ছিল বহরমপুর থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর— প্রায় ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার। ভাইকে সামনে রেখে সেই রেকর্ডও ম্লান করে দিয়েছেন শুভেন্দু। লোকসভায় সর্বোচ্চ ব্যবধানের জয় যেমন এখন দিব্যেন্দুর দখলে, তেমনই নন্দীগ্রাম থেকে রাজ্যের সবক’টি বিধানসভার মধ্যে সব চেয়ে বড় অঙ্কের ‘লিড’ও নিশ্চিত করা গিয়েছে! দিনের শেষে তৃপ্ত তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাই বলতে পেরেছেন, ‘‘উপনির্বাচনের ফল ১৫টি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষের রায়। কিন্তু আসলে এটা ২৯৪টা বিধানসভা কেন্দ্রেরই মানুষের মনের ভাষা!’’
বিধানসভায় শোচনীয় ভরাডুবির পরে রাজ্যে বিরোধী শিবির মনোবলহীনই ছিল। উপনির্বাচনের ঝড় তাদের অস্তিত্বের সঙ্কট আরও ঘোরালো করে তুলল বলেই রাজনৈতিক শিবিরের মত। বিধানসভা ভোটের পরে দলের মধ্যেই বিতর্ক এবং দোষারোপের ধাক্কায় সিপিএমের পলিটব্যুরো কংগ্রেসের হাত ছ়়েড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আলাদা লড়ে এ বার বামেদের ভোট তিন কেন্দ্রের কোথাও ২৫% ছুঁতে পারেনি। কংগ্রেসের হাল আরও করুণ! মন্তেশ্বর ও তমলুকে তারা দেড় শতাংশ করে ভোট পেয়েছে! কোচবিহারে তুলনায় একটু ভাল— ২.৪৯%!
সে দিক থেকে মন্দের ভাল বিজেপি। উত্তরবঙ্গে ছিটমহল আন্দোলনে প্রভাব কাজে লাগিয়ে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে তাদের ভোট গত বিধানসভার চেয়ে প্রায় ১৬% বেড়েছে। ওই কেন্দ্রে তারাই দ্বিতীয়। আবার তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে নন্দীগ্রাম বিধানসভা এলাকায় তারা প্রায় চমক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে এসেছে। যার ভিত্তিতে বিজেপি নেতাদের আশা, পরের লোকসভায় তৃণমূলের মূল প্রতিপক্ষ হবেন তাঁরাই।
বাম ও কংগ্রেস নেতাদের দাবি, উপনির্বাচন প্রহসন হয়েছে! তাই এই ফল থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক নয়। ভোটের দু’দিন আগে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু অভিযোগ করেছিলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত ভোটকর্মীদের তালিকা নিয়ে শাসক দল চাপ সৃষ্টি করছে, বিরোধীদের প্রচার করতে বাধা দিচ্ছে, ভোটারদের ভয় দেখানো হচ্ছে, তার পরে ভোট প্রহসনই হবে। ভোটের দিন বুথ থেকে বিরোধী এজেন্টদের বার করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল। ফল থেকে সেই প্রহসনই স্পষ্ট হল বলে মন্তব্য বিমানবাবুর। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানও প্রহসনের কথা বলেছেন। আর সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, ‘‘বামেদের ধূলিসাৎ করে মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি-কে জায়গা দিতে চাইছেন। উপনির্বাচনে সেটা আবার স্পষ্ট। ’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy