নজর পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।
টিপটিপ বৃষ্টির নিশুত রাতে সারা তল্লাট সুনসান। আমগেরস্ত দোর এঁটে দু’চোখের পাতা এক করেছে। কিন্তু একটু দূরে রাস্তার দু’ধারে ছায়া-আবছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কারা?
‘‘সব লাইনম্যান। আমার মতো।’’— পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দিলেন মুক্তো— ‘‘ওয়েট করছে। কখন ধুর আসবে। ঝটপট চালান করতে হবে তো।’’
‘ধুর’, মানে চোরাপথের মানুষ। সীমান্তের মাটিতে দাঁড়ানো এক ‘পারানি’র মুখের ওই কথাই বুঝিয়ে দিল, ‘বন্দোবস্ত’ থাকলে উপায় হয়। কাঁটার বেড়ায় কিচ্ছুটি আটকায় না। গরু, সোনা, নিষিদ্ধ কাশির সিরাপের সঙ্গে দেদার পাচার করা যায় জাল নোট, মাদক, নারী। ঢুকতে
পারে জঙ্গিও।
ঢাকার গুলশন-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তের এ হেন অরক্ষিত চেহারাটা ফের প্রকট হয়ে উঠেছে। উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিধানসভায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ষাট বছরেও সীমান্তে বেড়ার কাজ শেষ হল না কেন? সুরক্ষা-বিশেষজ্ঞেরা যদিও বলছেন, শুধু বেড়া খাড়া করে অনুপ্রবেশ বা নাশকতা
ঠেকানো অসম্ভব।
বস্তুত বুধবার রাতদুপুরে বনগাঁ সীমান্তে চক্কর মেরে তেমনটাই মালুম হল। কী রকম?
আংড়াইলে ইছামতীর পাড়। ও-পারে যশোরের পুঁটখালি। ঠাহর করে দেখা গেল, আঁধার নদী নিঃশব্দে চিরে চলেছে দেশি নৌকো। সওয়ারি কারা, কী মতলব, জানার উপায় নেই। আংড়াইলে যেমন জল-সীমান্ত, তেমন দু’কিলোমিটার দূরে বর্ণবাড়িয়ায় স্থল-সীমান্ত। সেখানে কাঁটাতারের বেড়ার সদর্প উপস্থিতি। ‘‘তাতে কী? শুধু অন্ধকার নামতে যা দেরি। বেড়া গলে নদীতে নেমে যাবে গরুর পাল। সাঁতরে দিব্যি চলে যাবে ও-পারে। ওখানে পার্টি রেডি রয়েছে।’’— বললেন মুক্তো। জানিয়ে রাখলেন, ও-পারে বিজিবি, এ-পারে বিএসএফের পাহারা সত্ত্বেও ‘ধুর’ আসা আটকাচ্ছে না। লাইনের ছেলেপুলেদের পকেটেও
দু’পয়সা আসছে।
বর্ণবাড়িয়া হাটের পাশে মুক্তোর চিলতে টালির ঘর। রাত ডিউটিতে ‘ধুর’ ধরে দৈনিক চারশো টাকা আয়। সংসার আছে। বাড়ির টিভি’তে কেব্ল লাইন আছে। বাংলাদেশের অবস্থা বিলক্ষণ জানেন। রক্তারক্তির খবরে বিমর্ষও হন। ধুরদের সঙ্গে মিশে খুনিরা তো এ দেশে ঢুকে
পড়তে পারে?’’
‘‘কে ভাল লোক আর কে খারাপ, বুঝব কী করে বলুন তো? তা ছাড়া পেট চালাতে হবে!’’— সাফাই দেন মুক্তো। আর এক লাইনম্যান শ্যাম অবশ্য পেশার প্রশ্নে অকপট— ‘‘বেড়া আছে তো কী! লাইন আমাদের খোলা আছে, খোলা থাকবে। রুটি-রুজির সওয়াল।’’
বংলাদেশে হিংসার দাপটে বিশ্ব তোলপাড় হলেও বনগাঁ-বসিরহাটের মাঝামাঝি আংড়াইল, বর্ণবাড়িয়ার মতো ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ তার ছাপ নেই। পাচারের স্রোতে এক তিল ভাটা পড়েনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কয়েক মাস আগে এখানে ঘুরে গিয়ে চোরাপথে সীমান্ত পারাপার বন্ধের বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন ক’দিন চুপচাপ থেকে ধুরের গাঙ্গে ফের জোয়ার। সীমান্তের দায়িত্বে থাকা এক গোয়েন্দা-কর্ত্রী বলেন, ‘‘মানুষ-গরু-জাল নোট-মাদকের চোরাচালান বন্ধ হয়নি। একই রকম বেপরোয়া ভাব। কে জানে, ধুরের মধ্যে হয়তো জঙ্গিও আছে!’’ সন্ধ্যা হালদারের (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে কথা হচ্ছিল বৃহস্পতিবার সকালে। আংড়াইল বাজারের কাছে বাড়ি। জানালেন, ফি রাতে বাড়ির উঠোন দিয়ে পালে পালে গরু যায়। চেঁচামেচি, গালাগালি, জোরালো টর্চের আলো। রাতভর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। আপত্তি
করেন না?
আঁতকে ওঠেন সন্ধ্যাদেবী— ‘‘পাগল নাকি! ওদের ক্ষমতার কোনও ধারণা আছে? বিএসএফ, পুলিশ, নেতা— সব ওদের হাতে। কোটি কোটি টাকার কারবার।’’ আংড়াইল প্রাইমারি স্কুলের এক প্রাক্তন শিক্ষকের আক্ষেপ, ‘‘পাচারের হিড়িকে এখানকার সংস্কৃতিটাই বদলে গিয়েছে!’’ বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিমত, সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া আসলে চোখের সুখ। কাজের কাজ তাতে কিছুই হচ্ছে না। বেআইনি পারাপার দিব্যি চলছে।
সীমান্তে নজরদারি-পরিকাঠামোর ছবিটা ঠিক কেমন?
বিএসএফের তথ্যানুযায়ী, দুই বাংলার মধ্যে স্থল-জলপথ মিলিয়ে মোট ২২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত। নদী বাদ দিয়ে ১৪২১ কিলোমিটারে দু’দফায় বেড়া তোলার পরিকল্পনা করেছে দিল্লি। এখনও অরক্ষিত ১৮০ কিমি। জমি পেতে সমস্যা ছিল। সম্প্রতি রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে বেড়ার জমি কিনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে রাজি হয়েছে। জমির অভাবে ২২৩টি সীমান্ত-চৌকির (বর্ডার আউটপোস্ট) কাজও আটকে রয়েছে বলে বিএসএফের অভিযোগ।
জল-সীমান্তেও প্রহরা বাড়ন্ত। বাংলাদেশ লাগোয়া সুন্দরবন উপকূলের প্রায় ৩৬ কিমি জলপথ বিএসএফের নজরদারির আওতায়। কিন্তু সেখানেও সাকুল্যে তিনটি ভাসমান আউটপোস্ট। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, সীমান্তের নদীপথ সবচেয়ে অরক্ষিত বসিরহাট থেকে মুর্শিদাবাদে। উত্তর ২৪ পরগনায় তো ১৩২ কিমি সীমান্ত-নদীপথের কোথাওই বেড়া নেই।
উত্তরবঙ্গও তথৈবচ।
কিন্তু যেখানে বেড়া বহাল, সেখানেও পাচার-রাজের রমরমা দেখে গোয়েন্দাদের বড় অংশ প্রমাদ গুনছেন। এ জন্য নজরদারির গোড়ার গলদের দিকে আঙুল তুলছেন তাঁরা। বড় বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এই গাফিলতির মাসুল গুনতে হতে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন।
সীমান্তের মাটিতে এক রাতের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, আশঙ্কার ভিত যথেষ্ট মজবুত।
(তথ্য সহায়তা: জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য, দীক্ষা ভুঁইয়া, নির্মল বসু, সীমান্ত মৈত্র)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy